মধুজা মুখোপাধ্যায়
এক মাথা ভর্তি লম্বা অবিন্যস্ত পাকা চুল পালক গোঁজা টুপিতে ঢাকা, গাল থেকে লম্বা ধবধবে পাকা দাড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে, পরনে জীর্ণ একখানা কোট, ছোট হয়ে যাওয়া প্যান্ট, পায়ের পাতার থেকে ছোট হয়ে যাওয়া বুট জুতোর মাথা ফুঁড়ে পায়ের আঙুল বেরিয়ে পড়েছে। এই হল সাহেবের সাজের বহর! ডান চোখ থেকে বাম চোখ বা কপাল থেকে দাড়ি বিস্ময়ে মাখামাখি। সবে মাত্র ঘুম ভেঙেছে তাঁর, পাশে জং ধরা লম্বা নলের বন্দুক। ঘুম থেকে উঠে চোখের সামনে সভ্যতার চরম নিদর্শন দেখে সাহেব হতবাক। কী খেয়েছিলেন সাহেব যে কুড়ি বছরের জন্য অনন্ত নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন? তাঁর কলহপ্রবঁ স্ত্রী বা সন্তানসন্ততি কোথায়? কিছুই জানেন না তিনি। তাঁর অনুগত কুকুর কোথাও নেই। শুধু সবাই জানেন, স্ত্রীর অত্যাচারে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন রিপ ভ্যান উইঙ্কল, তাঁর প্রিয় উল্ফকে সঙ্গে নিয়ে। নিউয়র্ক রাজ্যের ক্যাটস্কিল পর্বতমালায় রহস্যময় যাযাবরদের সঙ্গে তাঁর দেখা, তাঁদের দেওয়া অনামী পানীয় সেবন করে অনন্ত নিদ্রায় মগ্ন হয়েছিলেন তিনি। আর বাকিটা ইতিহাস। হ্যা, ঠিক ধরা গেছে। আমি বলছি মার্কিন সাহিত্যিক ওয়াশিংটন আরভিং এর বিখ্যাত ছোট গল্প রিপ ভ্যান উইঙ্কল এর কথা।
স্কুল লাইফে অনেকেরই পাঠ্য ছিল এই গল্প। গল্পখানা পড়তে পড়তে রিপ ভ্যানকে খুব হিংসে হত। হত না বলে এখনও হিংসে হয় বলাই ভাল। ২০ বছরের নিশ্চিন্ত ঘুম এবং তারপর বর্তমান জীবনেই নতুন জীবন প্রাপ্তি। ভাবা যায়? ব্যাস আর কী চাই! চোখে মুখে বিস্ময় মাখা বৃদ্ধ রিপ ভ্যানের নতুন জীবন শুরু করার মাহেন্দ্রক্ষণটি অমর করে রাখা আছে হাডসন নদীর ধারে। নিউইয়র্ক রাজ্যের ছোট্ট একটি গ্রাম আরভিংটন। সেখানে রিপ ভ্যান এর সেই বিখ্যাত ব্রোঞ্জের মূর্তি দেখতে বহু সাহিত্যপ্রেমী ভীড় জমান। মূর্তিখানা এতটাই জীবন্ত যে ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখা যায়।
কোনও এক গ্রীস্মকালে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেছিলাম হাডসনের ধারে। নদীর ধারের গাছগুলোর ভেতর দিয়ে আলোর সরল রেখাগুলো ভেঙেচুরে পাথুরে রাস্তায় অপটু হাতে নক্সা কেটে রেখেছে। ঠিক যেন রহস্যময় যাযাবর দলের নাইন পিন খেলা দেখানোর পালা শুরু হওয়ার প্রস্তুতি। নদীর ধার থেকে চড়াই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বুড়ো সাহেবের সঙ্গে দেখা হল। উইঙ্কল সাহেবের মুখ জুড়ে অসংখ্য বলিরেখা বয়ে যাওয়া সময়ের দলিল। শরৎকালে স্থানীয় গাছগুলির রঙিন ঝরা পাতার চাঁদোয়া দিয়ে সাহেব ঢাকা পড়ে থাকেন। আর বছরের বাকি সময় তাঁর শরীর জুড়ে খোদাই করা ঝরা পাতা ঝরে যাওয়া সময়ের পিওন। সাহেবকে সেদিন কানে কানে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কুড়ি বছর পর পৃথিবীকে কেমন দেখলেন? উত্তরে তিনি স্রেফ দুটো শব্দ বলেছিলেন।
পৃথিবীর আজ নাকি ভয়ানক অসুখ। এমন অসুখ যে মানুষ গৃহবন্দি হয়ে নাস্তানাবুদ। কিছুতেই সেই অসুখকে জব্দ করা যাচ্ছে না। কোনও অদৃশ্য যাযাবর যেন গোটা পৃথিবীকে সেই রহস্যময় পানীয়র সন্ধান পাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। বুড়ো সাহেবের সঙ্গে আবার দেখা হলে জিজ্ঞাসা করব, ‘সাহেব, অসুখের পর পৃথিবীকে কেমন দেখব বলুন তো?’ উত্তর আসবে সেই দুই শব্দ, ‘অবাক পৃথিবী’।