একটি জীবনের আড়ালে

সজল মুখার্জি

ছবিটা যখন প্রথম দেখি, তখন নিতান্তই স্কুলছাত্র। দেখেছিলাম, ভাল লেগেছিল। ব্যাস, ওইটুকুই। এর বেশি গভীরে তলিয়ে দেখার মতো বয়স বা বিদ্যেবুদ্ধি কিছুই ছিল না। শুধু জানতাম, এটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবি। কে লেখক, কে পরিচালক, এসব জানতে ভারী বয়েই গেছে।
পরে আর কখনও টিভিতে ছবিটা দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। এমনকী ছবির নামটাও ভুলে গিয়েছিলাম। মাঝে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে কোনও একটা পত্রিকায় নানা লেখার মাঝে এই ছবিটার উল্লেখ পাই। তখনই ভেবেছিলাম, এই ছবিটা আবার দেখতে হবে। ইউটিউবে আগে খুঁজেছি। পাইনি। সেদিন হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম। অনেক নির্ধারিত কাজ মুলতুবি রেখে দেখেও ফেললাম।

ekti jiban2
ছবির নাম— একটি জীবন। সৌমিত্র ছাড়াও আছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। পরিচালক রাজা মিত্র। এটিই তাঁর প্রথম ছবি। প্রথম ছবিতেই পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। টিভিতে ছবিটা দেখেছিলাম নয়ের দশকের গোড়ায়। আগে একটা রেওয়াজ ছিল, টিভিতে দিচ্ছে মানে পুরনো ছবি। তখন সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম, ছবিটা ১৯৮৭ সালের। অর্থাৎ, মুক্তির চার–‌পাঁচ বছরের মধ্যেই টিভিতে দিয়েছিল। হয়ত পুরস্কার পাওয়া ছবি বলেই বেশি পুরনো হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি।

গল্পটা একজন অভিধানকারকে নিয়ে। সৌমিত্র হলেন গ্রামের স্কুলের এক মাস্টারমশাই। বিভিন্ন শব্দের নানা রকম অর্থ নিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। ঠিক করলেন একটা বাংলা অভিধান রচনা করবেন। শব্দের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন অনন্ত যাত্রায়। ঝাঁপিয়ে পড়লেন শব্দের মহাসমুদ্রে। কখনও ছুটছেন মাদ্রাসা শিক্ষকের কাছে, কখনও যাত্রাগানের আসরে, কখনও কলেজের লাইব্রেরিতে, কখনও বিদ্যানদের কাছে। খুঁজে পেলেন একের পর এক শব্দ, বিচিত্র তার মানে। বাংলা শব্দের সঙ্গে কোথায় মিশেছে আরবি, ফারসি!‌ লৌকিক গানে কোথায় লুকিয়ে আছে শব্দ ও ভাষার জাগলিং। গোটা জীবনটাই যেন পেরিয়ে গেল এই শব্দের সন্ধানে। দুঃখ এসেছে, বিপর্যয় এসেছে, শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছেন। তবু পিছিয়ে আসেননি। নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠা বা প্যাশন কাকে বলে, এই ছবি তার একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। যে কোনও মহৎ কাজের পেছনে কত পরিশ্রম, কত লড়াই, কত উপেক্ষা, কত পাগলামি, কত লুকোনো যন্ত্রণা মিশে থাকে, এই ছবিটা যেন সেই বার্তাও রেখে গেল।

ekti jiban
অনেকে বলেন, এটা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনী। কিছু মিল হয়ত আছে। কিন্তু অমিলের পাল্লাটাই ভারী। মূল কাহিনী বুদ্ধদেব বসুর। সেখান থেকে অসাধারণ চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন রাজা মিত্র। তিন দশকেরও আগের কথা। জীবনের প্রথম ছবি, এমন একটা বিষয় নিয়ে!‌ সত্যিই সাহস লাগে। এত বছর নতুন করে কুর্নিশ জানাই পরিচালককে। নিঃসন্দেহে সৌমিত্রবাবুর সেরা ছবিগুলোর একটা। কিন্তু সেভাবে প্রচারের আলোয় আসেনি। সৌমিত্রর অন্যান্য ছবি নিয়ে যেভাবে আলোচনা হয়, এই ছবিটা নিয়ে তেমন আলোচনা শোনা যায় না। কী জানি, সত্যজিৎ রায়–‌মৃণাল সেনদের মতো কিংবদন্তি পরিচালকদের ছবি নয় বলেই হয়ত কিছুটা অনাদরে থেকে গিয়েছিল।
লকডাউনকে সত্যিই ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। ছবিটা ইউটিউবে ছিল ঠিকই। কিন্তু লকডাউন না হলে হয়ত খুঁজে দেখার তাগিদটাই হয়ত আসত না। বাংলা ভাষার প্রতি যাঁদের দরদ আছে, তাঁরা দ্রুত দেখে ফেলুন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.