শ্রাবণের ধারা এভাবেই ভিজিয়ে দিয়ে যাক

স্মৃতি ফ্যাকাসে হতে হতে একসময় কাছের মানুষদেরই অচেনা মনে হয়। ‘‌সব পাখি ঘরে আসে’‌ বলেও পরের লাইনগুলো কিছুতেই আর মনে আসে না। এমন চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সবমিলিয়ে শ্রাবণের ধারা যেন অনেককিছুই ঝরিয়ে গেল। এ যেন ভেতরঘরে বৃষ্টি। লিখেছেন অন্তরা চৌধুরি।।

ফুরিয়ে যাওয়ার আগে শ্রাবণের ধারার মতো ভালবাসার ধারা যদি আরও একবার এ জীবনে নেমে আসে ক্ষতি কী! সুদেষ্ণা রায়, অভিজিৎ গুহ আরও একবার প্রমাণ করলেন, ভালবাসার দ্বারা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। জীবনের পশ্চিম সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া এককালের নামী অধ্যাপক অমিতাভ সরকার (‌সৌমিত্র)‌ অ্যালঝাইমারে আক্রান্ত। প্রথমা স্ত্রী শুভা অনেক আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। শান্তিনিকেতনে লেকচার দিতে আসা প্রৌঢ় প্রফেসর ডঃ অমিতাভ সরকারের প্রেমে পড়ে তরুণী রিসার্চ স্কলার জয়িতা (‌গার্গী)‌। অসম বয়স, চাওয়া পাওয়ার হিসেবকে ম্লান করে আবার বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়েন দুজনে। কিন্তু ডিমনেশিয়ায় আক্রান্ত অমিতাভর মন থেকে বর্তমান সমস্ত স্মৃতি মুছে যেতে থাকে। স্মৃতিপটে আঁকা থাকে শুধু প্রথমা স্ত্রী শুভার ছবি। কলকাতার সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে ডঃ নীলাভ রায় (‌পরমব্রত)‌ আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন সৌমিত্রর স্মৃতি ফেরানোর।

srabaner dhara
এই প্রসঙ্গে এখানে উঠে এসেছে অনেকগুলি সামাজিক বিষয়। সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের ডাক্তারদের চিকিৎসা করাই শেষ কথা নয়। তাঁদেরকেও নির্দিষ্ট টার্গেট অ্যাচিভ করতে হয়। অকারণ টেস্ট এবং অকারণ অপারেশন না করালে কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়ে যেতে হয়। একসময়ে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করা ডঃ নিলাভ রায় টালা পার্কের বারো ঘর এক উঠোন ছেড়ে পাড়ি দেয় কুড়ি তলার ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটে। এত বিলাস, বৈভবের মাঝেও কোথায় যেন নিঃসঙ্গ। যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য দিলেও প্রকৃত সুখের ঠিকানা দিতে অপারগ। আর এটাই স্পষ্ট হয়ে যায় নীলাভর ছোটোবেলার ফুটবল খেলার বন্ধু সুব্রতর (‌পদ্মনাভ)‌ বাড়ি গিয়ে। বাবা, মা, বোন, স্ত্রী, মেয়ে সকলকে ছেড়ে কার্যত একা নীলাভ টাকা আর যশের পেছনে দৌড়তে দৌড়তে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। সুব্রতর ভালোবাসায় মোড়া গরিবখানায় গিয়ে সে তার ভুল বুঝতে পারেন। অটোচালক সুব্রতর ভালবাসার ঐশ্বর্যের কাছে ম্লান হয়ে যায় বিখ্যাত ডঃ নীলাভ রায়।
স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য ভারতীয় নারী যুগে যুগে অনেক কিছু করেছে। আমাদের জয়িতাও নিজের অস্তিত্বকে হাসি মুখে বিসর্জন দিয়ে শুভার অভিনয় করে চলেন নিপুণভাবে। শুভার মতোই নীল শাড়ি, পুরনো ফ্রেমের চশমা। এভাবেই তাঁর অস্তিত্ব যেন শুভার মাঝেই বিলীন হয়ে যায়। প্রৌঢ় প্রফেসর মাঝেই মাঝেই বলে ওঠেন, ‘সব পাখি ঘরে আসে’। পরের লাইনগুলো কিছুতেই মনে করতে পারেন না। চারপাশের চেনা জগৎ একটু একটু করে ফ্যাকাসে হতে শুরু করে। যে মানুষের অতীত মুছে গেছে, ভবিষ্যৎ বলেও কিছু নেই; সেই মানুষের বর্তমানকে আরও একবার ভালবাসায় মুড়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন জয়িতা, ওরফে নতুন বন্ধু, ওরফে নতুন প্রেমিকা। একই মানুষের সঙ্গে নতুন করে প্রেমে পড়ার আনন্দটা নেহাত কম নয়। ভালবাসার পূর্ণতা আছে বলেই তো আমাদের পৃথিবীটা আজও এত সুন্দর।

srabaner dhara3
এ তো গেল গল্পের কথা। কিন্তু পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে নানা মুগ্ধতা। চিত্রনাট্য আপাতভাবে মন্থর মনে হলেও বেশ সাবলীল। সংলাপ বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। সুক্ষ্ম হিউমার মাঝে মাঝেই ডালপালা মেলেছে। বড় যত্ন নিয়ে নির্মিত হয়েছে দৃশ্যগুলি। বারবার ভুলে যাওয়া মুহূর্তগুলো বড় বেশি জীবন্ত মনে হয়েছে সৌমিত্রর অভিব্যক্তিতে। শুধু অভিব্যক্তি এখনও কত না বলা কথা বলে যায়। এই বয়সেও সৌমিত্র কতটা অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারেন, তার বার্তা রেখে গেল এই ছবি। গার্গীর অভিনয় বেশ পরিণত। এই চরিত্রটি টলিউডে আর কেউ এভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারতেন বলে মনে হয় না। দ্বিধা, ‌দ্বন্দ্ব, ‌একাকীত্ব, প্যাশন, ‌আপস সবমিলিয়ে পরমব্রতও বেশ সাবলীল। আউটডোর লোকেশান হিসেবে সোনাঝুরির জঙ্গলকে খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে হাসপাতালের চৌহদ্দি ছেড়ে আরও একটু শান্তিনিকেতন ধরা দিলে, মন্দ হত না।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.