মেয়েদের এতবড় বন্ধু আর কেউ আছেন!

তিনি কী কী সাহিত্য রচনা করেছেন, বাংলা গদ্যকে কতখানি সাবলীল করেছেন, সেসব সাহিত্যের গবেষকরা বলবেন। সমাজ সংস্কারে কতটা দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, সেকথাও কারও অজানা নয়। কিন্তু সেসবের পাশাপাশি বলতেই হয়, এই দেশে মেয়েদের এত বড় বন্ধু আর আসেনি। লিখেছেন মধুজা মৈত্র।

 

সময়ের একটা নিজস্ব গতি আছে। আমরা অনেকেই সেই গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করি। আধুনিক প্রযুক্তি থেকে শুধু করে আধুনিকতার নানা উপাদান আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু বহিরঙ্গে যতখানি আধুনিকতা এসেছে, ভেতরে ভেতরে কি আমরা সত্যিই ততখানি আধুনিক!‌ এই সময়ের বুকে দাঁড়িয়েও আমরা বিধবা বিবাহের কথা ভাবতে পারি না। এখানে–‌ওখানে বিধবা বিবাহ হচ্ছে ঠিকই। সিনেমা–‌সিরিয়ালেও দেখা যায়। কিন্তু আমাদের পাড়ায়, আমাদের গ্রামে সচরাচর দেখা যায় না। অথচ, দেড়শো বছর আগে একটা মানুষ ভাবতে পেরেছিলেন। শুধু ভাবনাতে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সমাজের সঙ্গে লড়াই করে সেই আইন প্রণয়ন করতে পেরেছিলেন।
এখনও মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে দেখি, নাবালিকার বিয়ে রুখে দিল প্রশাসন। কত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। অথচ, নারীদের এই সমস্যাটির কথাও দেড়শো বছর আগে একজন মানুষ ভাবতে পেরেছিলেন। সেই নির্মম বাল্যবিবাহ রুখতে সমকালীন সমাজের বিরুদ্ধে প্রায় একাই লড়াই করে গেছেন। সেই মানুষটি আর কেউ নন, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

bidyasagarছোটবেলায় বর্ণপরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয়। প্রথম অক্ষরটাই শেখা তাঁর সৌজন্যে। সেই অক্ষরের সিঁড়ি বেয়েই জীবনের পথে আমরা এতটা এগিয়ে এসেছি। মেয়েরা মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছে, মেয়েরা দেশ ও রাজ্যের নেতৃত্ব দিচ্ছে। মেয়েরা কলেজ–‌ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে। মেয়েরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার হচ্ছে। মেয়েরা মাধ্যমিক–‌উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম হচ্ছে। আজকের দিনে এটা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। এগুলো দেখে আমরা কেউ আর অবাক হই না।
আজ রাস্তায়, বাসে, বাড়ির অন্দর মহলে মেয়েদের হাতে মোবাইল। সাধারণ গৃহবধূরাও দূরদেশের কোনও বন্ধুকে মেসেজ পাঠাচ্ছে। কত সহজেই সে দেশ বিদেশের নানা খবর জেনে নিচ্ছে। মেয়েরা এতটা এগিয়ে যাবে, দেড়শো বছর আগে এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। একজন পেরেছিলেন। তিনি ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এই মানুষটাই আমাদের দেশে মেয়েদের লড়াইকে অন্তত একশো বছর এগিয়ে দিয়েছেন।
একদিকে চলছে সমাজ সংস্কার। অন্যদিকে, তিনি উপলব্ধি করলেন, নারী জাতিকে যদি উন্নয়নে শামিল না করা যায়, তাহলে সমাজও এগোতে পারে না। আর নারীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সেরা পন্থা হল, তাদের শিক্ষিত করা। তাদের স্কুলে পাঠানো। কিন্তু যে সমাজ তখনও পুরোপুরি সতীদাহের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি, সে সমাজে তখনও নারী পর্দানসীন, যে সমাজে বাল্যবিবাহ, বহু বিবাহ নামক প্রথা রমরমিয়ে চলছে, সেখানে নারী শিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া খুব সহজ ছিল না। সমাজের বড় একটা অংশই ছিল রক্ষণশীল, গোঁড়া। সেই গোঁড়ামির প্রাচীর ভেঙে মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেও বুকের পাটা লাগে। ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবের সাহায্য নিয়ে তৈরি করলেন হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়। শুধু কলকাতায় নয়, শুধু বাংলায় নয়, গোটা ভারতবর্ষে এটাই ছিল মেয়েদের প্রথম স্কুল। অন্তত এই একটা ব্যাপারে বাংলা সারা ভারতকে পথ দেখিয়েছিল। বিদ্যাসাগর ছিলেন এই স্কুলের সম্পাদক। পরে এই স্কুলটি বেথুন স্কুল নামে পরিচিত হয়।
কিন্তু শিক্ষা কি শুধু কলকাতায় আটকে থাকবে?‌ বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করলেন, জেলায় জেলায় মহিলাদের শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। ১৮৫৭ সালে বর্ধমানেও তৈরি হল মহিলাদের স্কুল। ঠিক পরের বছরই বর্ধমানের পাশাপাশি বেছে নিলেন মেদিনীপুর, হুগলি, নদীয়া জেলাকে। এই চার জেলায় এক বছরে তৈরি হল ৩৫ টি মহিলাদের স্কুল। মাত্র ছ বছরের মধ্যে বাংলায় মহিলাদের স্কুলের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮। নিজের গ্রামেও মায়ের নামে তৈরি করেছেন ভগবতী বিদ্যালয়।
একদিকে দেশজুড়ে সিপাহী বিদ্রোহের আবহ, অন্যদিকে সমানতালে চলছে শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াই। সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি জেলায় জেলায় নারী শিক্ষায় যেন জোয়ার আসতে লাগল। সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে মেয়েরা স্কুলে যেতে লাগল। একটা সময় বাড়ির অভিভাবকরাও বুঝলেন, মেয়েদের শিক্ষার আলোয় আনতে হবে। তাঁরাও মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে দ্বিধা করলেন না। এত এত স্কুল তো হল। কিন্তু বই কেনা থেকে শুরু করে, শিক্ষকদের মাইনে দেওয়া, বিল্ডিং তৈরি করা— এর তো খরচ আছে। কোনও কিছুই থেমে থাকল না। আগাগোড়া লেগে রইলেন বিদ্যাসাগর। তিনি জানতেন, এই বিরাট কর্মকাণ্ড তিনি একা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না। এরসঙ্গে রাষ্ট্রশক্তিকে যুক্ত করতে হবে। ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন স্কুলকে এনে দিলেন আর্থিক সাহায্য। আবার কখনও নিজের টাকা থেকেই বই কিনে দিয়েছেন ছাত্রীদের। কখনও বই কিনতে গিয়ে, কখনও স্কুল তৈরি করতে গিয়ে ঋণের জালেও জড়াতে হয়েছে।
এসব করতে গিয়ে কম বাধার মধ্যে পড়তে হয়নি। পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের ব্রাত্য রাখাই যেখানে অলিখিত নিয়ম, সেখানে তিনি মেয়েদের তুলে আনতে চাইছেন পাদপ্রদীপের আলোয়। সমাজের অনেক বড় বড় মাথা বিষয়টাকে ভাল চোখে দেখেননি। নানা কুৎসা ও সমালোচনা ধেয়ে এসেছে তাঁর দিকে। কিন্তু প্রবল বাধার মুখে দাঁড়িয়েও নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পেরেছিলেন। সেদিন তিনি সেই লড়াইটা করতে পেরেছিলেন বলেই আজ মেয়েরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। আজ মেয়েরা স্মার্টফোন হাতে সারা পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারে। সেই মানুষটার জন্মের দুশো বছর। তিনি কী কী সাহিত্য রচনা করেছেন, বাংলা গদ্যকে কতখানি সাবলীল করেছেন, সেসব সাহিত্যের গবেষকরা বলবেন। সমাজ সংস্কারে কতটা দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, সেকথাও কারও অজানা নয়। কিন্তু সেসবের পাশাপাশি বলতেই হয়, এই দেশে মেয়েদের এত বড় বন্ধু আর আসেনি।
আসলে, তিনি সমকালের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। তাই সমকাল তাঁর মূল্যায়ণ করতে পারেনি। এই দুশো বছর পরেও কি আমরা তাঁর ঠিকঠাক মূল্যায়ণ করতে পেরেছি?‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.