এতদিন ভাবতেন, কলকাতা লিগ কোনও টুর্নামেন্টই নয়। মোহনবাগানের জয় যেন চোখ খুলে দিল। মনে হল, এটা বোধ হয় বিশ্বকাপের কাছাকাছি। দারুণ একটা ছবির বিষয় পেয়ে গেলেন গোত্র গুপ্ত। রম্যরচনায় সেই কাহিনীই তুলে আনলেন কুণাল দাশগুপ্ত।।
বিকেলবেলা রেডিওতে শুনছিলাম কবীর সুমনের গান, মন খারাপ করে বিকেল মানেই মেঘ করেছে। অবাক হচ্ছিলাম, মেজাজটাও গরমই হচ্ছিল। মন খারাপের আবার কোনও শর্ত লাগে নাকি! গত বেশ কয়েকটা দিন ধরে সবসময়ই মনখারাপ। ওই টিভি চ্যানেলের মতো, ২৪x৭। রক্তাল্পনতার ওষুধ রয়েছে। অর্থাল্পতার আছে কি?
অফিসে সম্পাদকমশাই কবে যে শেষবারের মতো ইনসেনটিভ দিয়েছেন, তা স্মৃতির চৌকাঠ পর্যন্ত আসছে না। অথচ, ভিটামিন এম–এর ইনটেনসিটি ঠিকঠাক না থাকলে সংসারটাই যে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে চলে যায়, সেটা বোঝাই কী করে?
সেদিন একটা তোবড়ানো মন নিয়ে অফিসে গেছি। আর সম্পাদক মশাইয়ের সেই হাড়হিম করা ডাক — গোত্র গুপ্ত, ঘরে এসো। ঘরে যেতেই বললেন, ‘মুখটা এমন ভেটকি মাছের মতো করে রয়েছ কেন? মনটাই যদি ফ্যাকাসে হয়ে যায়, শিল্পী গোত্র গুপ্ত, আমি রঙ নির্বাচন করব কীভাবে? করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গের মতো স্থির করলাম, যা হবে, হোক। আজকে স্যারকে টাকার কথাটা বলতেই হবে। বলেও ফেললাম সাহস করে। স্যার বললেন, এই কারণেই কাগজে সব শোক, তাপ, বিষাদের ছবি আঁকছ। একটা আনন্দের ছবি আঁকো, পছন্দ হলে বাড়তি টাকা দিয়ে দেব।
আরিব্বাস, মুহূর্তে মনটা একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল। ছুটলাম আনন্দের ছবি আঁকতে। আঁকলাম। চারিদিকে গণেশ লাফাচ্ছে। ক্যাপশান দিলাম এখানে বারো মাসে চোদ্দ পাবণ, আষাঢ়, শ্রাবণ কী বৈশাখে।
স্যারকে দেখাতেই দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন। বললেন, মূর্খ, মহারাষ্ট্রিয়ান গণেশকে নিয়ে লম্ফঝম্প শুরু করে দিলে! এ গণেশ বাঙালির নয়। বাঙালির আনন্দ তুলে ধরো গিয়ে।
প্রত্যেক বারের মতো আবার একটা ছবি এঁকে নিয়ে গেলাম। সম্পাদক মশাই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, এর অর্থ কী? একটা পালতোলা নৌকো নিয়ে নাচছে লাল হলুদ, সবুজ মেরুণ সমর্থকরা। কেন? কী হল? পাগল হলে নাকি? বললাম, ‘স্যার মোহনবাগান এবার সিএফএল জিতেছে।’
আমাকে থামিয়ে স্যার বললেন, তাতে লাল হলুদ সমর্থক এল কোথা থেকে? তাদের এত পুলক কীসের?
স্যার, ইয়ে, মানে..। গত আট বছর ধরে লাল হলুদই জিতছিল। তখন সবুজ মেরুণরা বলত, ‘এটা নাকি ধর্মতলার ট্রফি, ভাদ্র মাসের ট্রফি। এটা ইস্টবেঙ্গলকে ছেড়ে দিই।’ এবার ওরা জিতে লাফাচ্ছে, মানে, এই প্রতিযোগিতাটা জাতে উঠেছে। ভাদ্র মাসের ট্রফি থেকে বিশ্বকাপে উন্নীত হয়েছে। আর নতুন করে স্বীকৃতি পেয়েছে মিত্র–বোস কোম্পানি থেকে। তাই ইস্টবেঙ্গলিরাও খুশি। ইস্টবেঙ্গলিদেরও মনে হত, কলকাতা লিগ সত্যিই হয়ত কোনও ট্রফি নয়। একটা হীনমন্যতায় ভুগত। মোহনবাগানের উল্লাস দেখে তাদেরও মনে হচ্ছে, এটা সত্যিই বিশ্বকাপ ছিল। তার মানে, আগের আট বছর তারা সত্যিই ভাল জাতের ট্রফি জিতেছিল। কলকাতা লিগের তাহলে সত্যিই গুরুত্ব আছে!
সম্পাদক জিজ্ঞেস করলেন, তা ক্যাপশন কী দেব? ‘মোহনবাগান জিতিয়া প্রমাণ করিল ইস্টবেঙ্গল হারে নাই।’
সত্যি বলছি, এই প্রথম স্যারকে দেখলাম, হা হা করে হাসতে। সংসারটা আইসিসিইউ থেকে আবার ফেরত এল।