হিমানীশের গল্পে সিনেমা জগতের অজানা উপাখ্যান

অন্তরা চৌধুরি

তিনি চলচ্চিত্র জগতের মানুষ নন। কখনও অভিনয় করেননি। এমনকী সিনেমার চিত্রনাট্যও লেখেননি। কিন্তু হিমানীশ গোস্বামীর বিভিন্ন লেখায় বাংলা ছবির নানা উপাখ্যান উঠে এসেছে। কিছুটা তির্যক দৃষ্টিতেই তিনি এই জগতকে দেখাতে চেয়েছেন। বাংলা ছবির নায়ক–‌নায়িকারা কেন হিন্দি ছবির হাতছানিতে সাড়া দেন, গ্ল্যামার ধরে রাখতে তাঁরা কী কী টোটকা প্রয়োগ করেন, এমন নানাবিদ হাসির উপাদান উঠে এসেছে তাঁর বিভিন্ন গল্পে। সবমিলিয়ে চলচ্চিত্র জগতের অনেক অজানা দিকের হদিশ উঠে আসে।

গল্পের নাম ‘মিলপুরের মেলা’। আলোচ্য গল্পে লেখক সংস্কৃতির জগৎকে মোক্ষম কটাক্ষ করেছেন। মিলপুর নামক জায়গায় দোলের সময় সাতদিন ধরে বিরাট মেলা চলে। কলকাতা থেকে বড় বড় সব নেতা, মন্ত্রী সেখানে যান। সাহিত্য, সঙ্গীত, কবিতা, যাত্রার বিশিষ্ট লোকেরা গিয়ে মিলপুরকে আরও সংস্কৃতিসম্পন জায়গায় পরিণত করেন। সেই মিলপুরের মেলায় টেকো আর গুঁফো নামে দুজন লোক কালচারাল কন্ট্রাক্ট পেয়েছে। পুরনো কালচারাল কমিটিকে হাটিয়ে এই টেকো আর গুঁফো কমিটি দখল করেছে। কিন্তু –
‘এই টেকোটি আর্ট কি জানে না, আর গুঁফোটি হয়ত রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন, কিন্তু বিভূতিভূষনের নাম তাঁর অজ্ঞাত।’
এহেন লোক যারা আর্ট বা শিল্পের কিছুই বোঝে না তারাই হয়েছে কালচারাল কন্ট্রাকটর। এখানে লেখক খুব সচেতনভাবেই এই দুটি লোকের চেহারার অসঙ্গতি দিয়েই বিশেষিত করেছেন। কোনও নাম দেননি। কারণ টেকো আর গুঁফো দুটোই যেন শিল্পের আঙিনায় বড় বেশি বেমানান। শিল্পী হওয়া যেমন সহজ নয় তেমন শিল্পের কদর করাও সহজ নয়। আর শিল্প যাপন করা তো আরও কঠিন। এই দুটি লোক ভুঁইফোড় হয়ে হঠাৎ করে শিল্পের সমঝদার হতে চায়। আর সেখানেই তৈরি হয় যাবতীয় সমস্যা। গল্পকথক ও তার বন্ধু হীরেন কলকাতার ‘কালু’দের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেবার কথা বলে। কলকাতার ‘কালু’ অর্থাৎ কালচারওয়ালারা- যাঁরা কালচার নিয়ে থাকেন, নাচ, গান, কবিতা লেখেন আর অনেকটা নাক উঁচু করে থাকেন লেখকের কথায় তাদেরকেই সংক্ষেপে বলা হয় ‘কালু’। অভিনেতা অভিনেত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা শুনে একটু দেঁতো হাসি হেসে নেন। ঠিক হয় যে প্রথমেই তারা দুমনা দেবীর বাড়িতে যাবেন। দুমনা দেবী অর্থাৎ টালিগঞ্জের নায়িকা এবং বোম্বাইয়ের বেশ বড় বড় পরিচালকের সঙ্গে তিনটে ফিল্মে কন্ট্রাক্ট করেছেন। বলা বাহুল্য এহেন দুমনা দেবীকে টেকো বা গুঁফো কেউ চেনেন না। শুধু তাঁর বোম্বেতে ফিল্ম কন্ট্রাক্ট করার কথা শুনেই তাঁরা দুমনা দেবীর জন্য পাঁচশো পর্যন্ত টাকা খরচ করতে রাজী।

himanish2
কিন্তু টেকো আর গুঁফোর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত দুমনা দেবীর দেখা হয় না। তারা দেওয়াল বেয়ে উঠে দুমনা দেবীর কুকুরদের মাংস খাওয়ানোতেই ব্যস্ত থাকেন। গুঁফো বলেন-
‘কলকাতার কালুদের সঙ্গে কথাবার্তা দেখাসাক্ষাৎ করাই আমার উদ্দেশ্য। তা আমি যদি দুমনা দেবীকে চাক্ষুষ দেখতে না পেলাম, কথাবার্তাই না বললাম, তাহলে আমার আসাই বা কেন? তারপর ঘোঁত করে বললেন, আমি নিশ্চয় দেওয়াল বাইব।’২
এমন সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষ এবং তাদের ‘কালচার’এর নমুনা সত্যিই অসাধারণ।
গল্পকথক এবং তাঁর বন্ধু তারুর সঙ্গে দুমনা দেবীর কথাবার্তা প্রসঙ্গে এই নায়িকাদের একটা অসহায়তার দিকও উঠে এসেছে। কারণ দুমনা দেবীর বাড়িতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ছুটে এসে জানতে চান, তাঁরা বোম্বে থেকে এসেছেন কি না। তখনকার দিনে নায়িকারা কলকাতায় সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও বোম্বে যাওয়ার একটা ঝোঁক কম বেশি সকলের মধ্যেই ছিল। বোম্বে যাওয়াটাই তাদের যোগ্যতার মাপকাঠি বলে মনে করা হত। শুধু তখনকার দিনে বলে নয়, বর্তমান যুগেও এই বোম্বে যাওয়ার প্রবণতা অধিকাংশ নায়ক-নায়িকার মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু সেখানে লড়াই করে টিকতে না পেরে আবার ফিরে আসে। এই দুমনা দেবীও তার ব্যাতিক্রম নন। এহেন নায়িকার নাম নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও হিমানীশ কটাক্ষ করেছেন। কটাক্ষ করেছেন তৎকালীন ফিল্ম ম্যাগাজিনকেও। গল্পে উল্লেখিত ম্যাগাজিনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘নাচানাচি’ যেখানে গুরুত্বপূর্ণ কোনও খবরের বদলে প্রকাশিত হয়- নায়িকার কটা কুকুর, তারা কি খায় সেসব। তাই তারু দুমনা দেবীর কাছে তার কুকুর সম্পর্কে জানতে চায়-
-‘আচ্ছা, তাদের যদি কেউ মাংস রুটি খেতে দেয়?
-মাংস ওরা ছোঁয় না। দুধ আর রুটি খায় ওরা কলা দিয়ে।
-মাংস ছোঁয় না?
-না।
-ওরা কতক্ষণ এরকম পাহারা দেয়?
দুমনা দেবী বললেন, আর বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এ-সব কথা বহুবার বহু কাগজে ছাপা হয়েছে-সেগুলো দেখে নেবেন, নমস্কার।’
যেমন নায়িকা, তেমনি তার কুকুর আর তেমনি স্তাবক সেইসব কাগজগুলো যেখানে নায়িকার কুকুরের যাবতীয় বৃত্তান্ত ফলাও করে ছাপা হয়। সংস্কৃতির নামে এক নিদারুণ প্রহসন চলে আমাদের সমাজে। এহেন সংস্কৃতিমনস্কতাকেই কটাক্ষ করেছেন লেখক আলোচ্য গল্পে।
গল্পের নাম ‘বারোটা বেজেছে’। শিক্ষিত বেকার যুবক গল্পকথক। বছরে চার-পাঁচটা কবিতা লেখে। এহেন গল্পকথক ইন্টারভিউ দিতে যাবার সময় হঠাৎ করে আবিষ্কার করে তাঁকে দুজন অপরিচিত ভদ্রলোক ‘ফলো’ করছেন। কবিতা লেখার দরুন কোনও নারী তাঁকে ফলো করলে ব্যাপারটা বেশ আনন্দদায়ক হতো। কিন্তু দুঃখের বিষয় দুজনেই পুরুষ। গল্পের শুরু এই দুজন পুরুষকে নিয়ে।
গল্পকথকের চাকরি দরকার। কিন্তু এয়ারকণ্ডিশন অফিসে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার মত পোষাক তাঁর ছিল না। এখানে লেখক ইন্টারভিউ এর নাম করে যে প্রহসন হয় তাকেও কটাক্ষ করেছেন। ইন্টারভিউ বোর্ডে ঢোকার পর একজন তাঁকে দাঁড়াতে বলেন, একজন বসতে বলেন। কী করবে বুঝতে না পেরে তিনি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই তৃতীয়জন প্রশ্ন করেন-
‘আপনার কি হাঁফানি আছে? একজন বললেন, আপনার সুট নেই?’
তিনি কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই তাঁকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়। ইন্টারভিউ বোর্ডের একটা অলিখিত নিয়ম থাকে- প্রার্থীকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়ার আগেই চরম বিব্রত করে দেওয়া যাতে তার ইন্টারভিউ নার্ভ শিথিল হয়ে যায়। এহেন ইন্টারভিউ-এর ক্ষেত্রে যোগ্যতা এবং মেধাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। প্রাধান্য দেওয়া হয় তার বহিরঙ্গের চাকচিক্য, আর সাজপোশাককে। প্রাধান্য পায় তার পরণে সুট আছে কি নেই।
যে দুজন লোক গল্পকথককে ফলো করছিলেন তাঁরা হলেন সিনেমা নির্মাতা। একজন হলেন হরিশ চাকলাদার, এবং আরেকজন হলেন ‘বারোটা বেজেছে’ ছবির ডিরেক্টর দীনু ভট্ট। ইতিপূর্বে তাঁরা ‘নরকে ভরাডুবি’ ছবি তৈরি করে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। শুধুমাত্র হাস্যরসের বাতাবরণ তৈরি করার জন্য এবং টলিউড ইন্ড্রাস্টির বিপন্নতা বোঝানোর জন্যই লেখক এমন নাম দিয়েছেন। আসল কথা হল সেই ছবির নায়ক লক্কা বোস সাঁতার কাটতে গিয়ে মারা যায়। হরিশ চাকলাদারে এই ছবি সম্পর্কে বলেন-
‘দারুণ গল্প মশাই-আজকালকার সমাজ নিয়ে লেখা মার মার কাট কাট ব্যাপার। দারুণ হাসির ব্যাপার, সমাজ সমেত প্রত্যেকটা লোক, নেতা, উপনেতা, শিক্ষক, অধ্যাপক, ছাত্র, ছাত্রী-এমনকী মশাই বারবনিতাদের পর্যন্ত চরিত্রের বারোটা বেজে গেছে।’৫
এই লক্কা বোসের সঙ্গে গল্প কথকের চেহারার অদ্ভুত মিল আছে। কাজেই তাকে লক্কা বোসের জায়গায় অভিনয় করতে হবে। বিশেষত তার বাঁকা হাসি- যা পাবলিকে খুব নিয়েছিল। কাজেই তারা গল্পকথককে কোনও মতেই হাতছাড়া করতে চায় না। এদের সঙ্গে কথপোকথন প্রসঙ্গে উঠে এসেছে গল্পকথকের জীবনে অনেক কিছু না পাওয়ার, মানুষ হিসেবে তাঁর গুরুত্বহীনতার যন্ত্রনার কাহিনি। আর ঠিক সেই কারণেই অভিনয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পরেই তিনি ‘না’ বলে দেন। কারণ তাঁর যুক্তি-
‘এই প্রথম আমি জীবনে পারব না কথাটা বলার সুযোগ পেয়েছি-ছেড়ে দেব কেন?’
যে কোনও উপায়ে তাঁকে পেতে পরিচালকরা মরিয়া। তাই তাঁরা যখন জানায় যে গল্পকথককে ছাড়া তাঁদের চলবে না, তখন তাঁর বক্তব্য-
‘এ যাবৎ শুনেছি আপনাকে ছাড়া বেশ চলে যাবে। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। কখনও কখনও ‘তোমাকে’ ছাড়া চলবে, আবার ‘তোকে’ ছাড়া চলবে, একথাও শুনেছি।’
সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সমাজে যা ঘটে তা সমকালীন লেখকের কলমে উঠে আসে। কোনও যুগপোযোগী লেখকের পক্ষেই সমকালকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার সেই সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় বিভিন্ন কালজয়ী সিনেমা, সিরিয়াল। বর্তমান যুগে যেমন মেগা সিরিয়ালের রমরমা আগেকার দিনেও তা ছিল। তবে এত সর্বাত্মক ছিল না। আলোচ্য গল্পের নাম ‘গুরুতর কিছু নয়’। এই গল্পে উঠে এসেছে অনেকগুলি অনালোকিত দিক যা হিমানীশের লেখনী স্পর্শে হয়ে উঠেছে যুগপোযোগী ও বাস্তব সম্মত। এই গল্পে উঠে এসেছে দর্শকের চাহিদা মেটাতে গিয়ে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য কীভাবে একজন লেখকের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। লেখক বা বকলমে স্ক্রিপ্ট রাইটারও বলা যায়। এখনকার বিভিন্ন সিরিয়ালে আমরা যখন আজগুবি দৃশ্য দেখি, তখন এই কথাগুলো মনে পড়ে যায়। তাই তাঁর লেখা সমকালীন না থেকে চিরকালীন হয়ে ওঠে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *