কুণাল দাশগুপ্ত
এমন কাণ্ডটা যাঁরা করলেন, তাঁরা বোধ হয় জানতেন না, যে পাথর ছুঁড়ে মারার সংস্কৃতির জন্য একশ্রেণির মানুষকে বিশ্ববাসী ঘৃণার চোখে দেখেন। তালিবান–জাম্বুবানদের মিশেলে এই দেশটাও শেষপর্যন্ত অসভ্যতার আতুরঘরে পরিণত হল। যাদের জন্য অনির্বাণ কংসবণিকের আজ এই অবস্থা, অত্যাধুনিক অভিধানেও তাঁদের উপযুক্ত বিশেষণ পাওয়া দুষ্কর। বিদেশের মাটিতে রেকর্ড সংখ্যক হেরে মোহনবাগান এদেশের তোবড়ানো গাল আর ভেঙে যাওয়া বুকে চুনকালি মাখিয়েছে। এবার মাঠের বাইরে তাদের সমর্থকরা জুরাসিক যুগে ফিরে গেলেন।
মোহনবাগানের এই বীরপুঙ্গবরা শুধু অনির্বাণের ভবিষ্যতকেই সংকটে ফেললেন না, মূল্যবোধকেও আইসিসিউ–তে পাঠালেন।
তাঁরা জানেন, তাঁদের পূর্বপুরুষরা যখন পায়রা ওড়াতেন আর লক্ষ টাকা খরচা করে বিড়ালের বিয়ে দিতেন, তখন কাঁটাতারের দাগ লাগা মানুষরা জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত ছিলেন। পরিণতি তাঁদের উত্তর পুরুষের হাতে কলম। আর পায়রাবাবুর ছেলেপুলেদের পাথর।
এমন একটা ঘটনার সাক্ষী আমিও। ইস্টবেঙ্গলের পত্রিকায় থাকাকালীন মোহনবাগান মাঠে অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় লিগের ডার্বি কভার করতে গিয়েছিলাম। প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িকতা কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, তা স্বচক্ষে দেখেছিলাম। মোহনবাগানের সদস্য গ্যালারিতে থাকা সবুজ মেরুন সমর্থকরা ক্রমাগত অশ্রাব্য, অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে চলেছিলেন। বাধ্য হয়ে মাঠ ছাড়তে হয় ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের। অসভ্যতা অব্যাহত। আজ যখন হাসপাতালে অনির্বাণ তাঁর দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করার জন্য পিতৃপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া অদম্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তখনও আক্রমণকারীদের সোশাল মিডিয়ায় ব্যঙ্গবিদ্রুপ অব্যাহত। সামাজিক মাধ্যমে মোহনবাগানের কৃতী সন্তানদের পোস্টের স্ক্রিন শট দেওয়া হল। তবে বিস্মিত হওয়ার জায়গা নেই অর্বাচীনরা খেলার জন্য আগুনকেই বেছে নেয়। বাংলার একটা বড় অংশের মানুষ খুশি হতেন যদি ক্লাবতাঁবু থেকে শিবদাস ভাদুড়ি, বিজয়দাস ভাদুড়ি, গোষ্ট পালদের ছবি সরিয়ে ফেলতেন। আশা করব, ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা সংযতই থাকবেন। যে ক্লাবের ঝুলিতে একটুও আন্তর্জাতিক ট্রফি নেই, উল্টে দু’বছর ভারতীয় ফুটবলকে নির্বাসনে পাঠানোর নজির রয়েছে, তাদের সঙ্গে একবন্ধনীতে আসতে চাইবেন না নিশ্চয়। এরা চিরকাল ‘জাতীয় ব্লাফ’ এর সমর্থক হিসেবে ধিকৃত হবেন।
কাগজে দেখছি, দুই ক্লাবই নাকি পাশে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ টাকা দিয়ে সাহায্য করছে। পাশে দাঁড়ানো অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু শুধু টাকা দিলে এই রোগ থেকেই যাবে। আগামীদিনেও টাকা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার এই রেওয়াজ থেকেই যাবে। ভবিষ্যতে যেন এই জাতীয় ঘটনা আর না ঘটে, সে ব্যাপারে বেশি সচেতন হওয়া দরকার। তাই, এই কাণ্ড যারাই করে থাকুক, তাদের সবার আগে ধিক্কার দেওয়া জরুরি। লড়াই হবে মাঠের মধ্যে। বাইরে টিকা–টিপ্পনি, যুক্তি–পরিসংখ্যানের লড়াই চলুক। কিন্তু এই ইট পাথরের লড়াই বন্ধ হোক।