বিনা লড়াইয়ে জেলা পরিষদ দখল। তাও নিশ্চিন্ত নয়। এবার হামলা চালানো হল অমিয় পাত্রর বাড়িতে। এত ভাঙচুর, এত হুমকির পরেও প্রার্থী কিন্তু প্রত্যাহার করানো গেল না। আর অন্যদিকে, নির্লজ্জ বিবৃতির ফোয়ারা। এই বিবৃতিগুলোই বলে দিচ্ছে, হামলার পেছনে আসলে কারা। লিখেছেন রক্তিম মিত্র।
১) যাক, সিপিমের মধ্যে এখনও তাহলে তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আছে!
২) যেখানে সিপিএম প্রার্থী খুঁজে পায় না, সেখানেও সিপিএমের প্রার্থী না হতে পারলে কর্মীরা তাহলে ভাঙচুর করে!
৩) এমনকী ২৩ বছরের জেলা সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের বাড়িতেও ভাঙচুর হতে পারে!
৪) সেই বিক্ষুব্ধ সিপিএম–দের অমিয় পাত্র চেনেন না, কিন্তু উড়ে গিয়ে জুড়ে বসা কলকাতার বিধায়ক ঠিক চেনেন।
উন্নয়নের মহিমা চারিদিকে। নতুন সংযোজন অমিয় পাত্র। তাঁর বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হল। দাবি, জেলা পরিষদে তালডাংরায় কেন সিপিএম প্রার্থী দিয়েছে। অবিলম্বে তুলে নিতে হবে। নইলে আবার চড়াও হব। হাত–পা ভেঙে দিয়ে যাব।
এত কিছুর পরেও সেই প্রার্থীকে সরানো যায়নি। ৫০–৬০ জনের তাণ্ডবের মুখে দাঁড়িয়েও অমিয় পাত্র সেই প্রার্থীকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেননি।
সাহস বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারে! অমিয় পাত্রর বাড়িতে ভাঙচুর করতেও ‘অনুপ্রেরণা’র অভাব হয় না। স্থানীয়রা ছিল না। বাইরে থেকেই এই গুন্ডাদের আমদানি করা হয়। ওপর তলার প্রশ্রয় ছাড়া, এরা হঠাৎ করে এল আর অমিয় পাত্রর বাড়ি ভাঙচুর করল! এতখানি সাহস এদের হবে!
দুজনের বিবৃতিতে চোখ বোলানো যাক। অরূপ চক্রবর্তী। জেলা পরিষদের সভাধিপতি। তাঁর দাবি, আমাদের কেউ যুক্ত নয়। এটা সিপিএমের অন্তর্দ্বন্দ্ব। বাকিদের কথা ছাড়ুন, নিজের স্ত্রীকে এমন নির্লজ্জ দাবির কথা বিশ্বাস করাতে পারবেন?
এবার তালডাংরার বিধায়ক সমীর চক্রবর্তী। কলকাতা থেকে উড়ে গিয়ে সেখানে জুড়ে বসেছেন। বিধাননগর পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান কৃষ্ণা চক্রবর্তীর স্বামী। কলকাতায়, আশেপাশে কোথাও জায়গা হয়নি। পাঠানো হয়েছে তালডাংরায়। এত খরচ করে জিতলেন, কিন্তু মন্ত্রী করা হল না। হতাশা আর রাখবেন কোথায়? নম্বর বাড়াতে তাঁকেও কিছু একটা করতে হবে। আর কী করলে নম্বর বাড়ে, বেশ জানেন।
তাঁর যুক্তি শোনা যাক। তিনি বললেন, সিপিএম বাইরের একজনকে তালডাংরায় প্রার্থী করেছে। তাই স্থানীয় সিপিমের কর্মীরা ক্ষোভে এই ভাঙচুর চালিয়েছে। হায় রে! সিপিএমের স্থানীয় কর্মীদের অমিয় পাত্র চেনেন না, চেনেন সল্টলেক নিবাসী সমীর চক্রবর্তী! কদিন আগেও তৃণমূল নেতারা বলে বেড়াচ্ছিলেন, ‘সিপিএম প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না।’ হ্যাঁ, এটা ঘটনা, শাসকের গুন্ডামিতে অনেকেই ভয় পেয়েছেন। পুলিশের ওপর ন্যূনতম আস্থাটুকুও রাখা যায়নি। তাই স্থানীয় অনেকেই প্রার্থী হতে রাজি হননি। বাধ্য হয়ে বাইরের একজনকে মনোনয়ন দিতে হয়েছে। তিনি হয়ত প্রচারেও আসতে পারবেন না। তাতেও এত ভয়?
ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। পাঁচ বছর আগের ছবিটা তুলে ধরা যাক। তালডাংরার অনেক জায়গায় গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে সিপিএম প্রার্থী দিতেই পারেনি। কিন্তু জেলা পরিষদের প্রার্থী দেওয়া গিয়েছিল। ভোটের দিন চূড়ান্ত শাসানি। বাম হিসেবে চিহ্নিত লোকেদের ভোটকেন্দ্রে যেতেই দেওয়া হল না। তা সত্ত্বেও বাক্স খুলতেই দেখা গেল, জিতে গেছে সিপিএম। ভেবে দেখুন, গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতিতে যাদের প্রার্থীই নেই, তারা কিনা জেলা পরিষদে জিতে গেল। এ যে কতবড় এক থাপ্পড়, যারা বোঝার, তাঁরা বোঝেন।
এবারও তেমনটা হবে না তো! যদি আবার এক থাপ্পড় খেতে হয়! তার থেকে প্রার্থীকে যেভাবে হোক, সরিয়ে দাও। গোটা রাজ্যেই তো বিরোধীশূন্য করার আয়োজন চলছে। বড়জোর আরেকটা কেন্দ্র বাড়বে!
তাই অমিয় পাত্রর বাড়ি আক্রমণ। কোনও তদন্তের দরকার নেই। নির্লজ্জের মতো বিবৃতিগুলোই বলে দিচ্ছে এর পেছনে কারা। ডিএম বা এসপি–র ওপর ভরসা করে লাভ নেই। খোদ ডিএম–এর দপ্তরে বিরোধীদের মারধর করা হচ্ছে, তাও তিনি কিছু করতে পারলেন না।
এমন একটা নোঙরা ঘটনার নিন্দা করবেন, এমন সৎসাহসটুকুও শাসকদের নেই। পুলিশের তো নেইই। সঙ্গে প্রশাসন, গুন্ডা, অর্থবল। তবু এঁরা কত ভীতু! অচেনা এক প্রার্থীকেও এঁদের কত ভয়! জেলা পরিষদ দখল হয়ে যাওয়ার পরেও এই ভয় যাচ্ছে না।