পাহাড়ের আনাচে কানাচে কত অচেনা জনপদ। দার্জিলিং–গ্যাংটক চিৎকারের আড়ালে সেগুলি চাপা পড়ে যায়। কার্শিয়াংয়ের কাছে তেমনই একটি মন ভালো করে দেওয়া জায়গা বাগোড়া। সেখান থেকে ঘুরে এসে লিখলেন অন্তরা চৌধুরী।।
ডিকি আন্টি,
আশা করি, ভাল আছো। এসে থেকে তোমাকে যে একটা ফোন করব, তারও সময় পাইনি। অবশ্য সময়কে দোষ দেব না। সময় যথেষ্টই ছিল। কিন্তু যা হয়! আজ করব, কাল করব, এই করে আর হয়ে ওঠেনি।
বিয়ের আগে থেকেই বাগোড়া জায়গাটার অনেক কথা শুনেছিলাম আমার পতিদেবের মুখে। মনে মনে একটা ছবি এঁকেই ফেলেছিলাম। ভাবতাম, ইসস, যদি এমন একটা জায়গায় যেতে পারতাম! অবশেষে, সুযোগ এসে গেল। ভ্রমণ ওরফে অর্ধেক হানিমুন বলা চলে। অর্ধেক এই কারণে, আমার পতিদেব সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইল তাঁর ক্ষুদ্র শ্যালক কুট্টুসকে। যদিও সে কাবাব-মে হাড্ডি মোটেও নয়। সে ছিল ছিল আমাদের মধ্যে রিলিফ ফ্যাক্টর।
তোমার ওখানে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা তোমাকে না লিখলে কেমন যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না। শিলিগুড়ি থেকে গাড়িটা যখন উপরের দিকে উঠছিল, তখন হালকা শীতের হিমেল হাওয়ার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছিলাম। গাড়ির জানালা দিয়ে হালকা মেঘ ভেসে আসছিল। ইচ্ছে করেই কার্শিয়াংয়ে নেমে গেলাম, এই শহরটাকেও তো একটু ছুঁয়ে যেতে হবে! হালকা টিফিন কার্শিয়াংয়েই সেরে নিলাম। সেই সঙ্গে মানচিত্রটাও কিছুটা বুঝে নিলাম। শুনলাম, ওখান থেকে দিলারাম হয়ে আর দু-তিন কিলোমিটার গেলেই নাকি বাগোড়া। কার্শিয়াং থেকেই তোমাকে একপ্রস্থ ফোন হয়ে গেল। জানিয়ে দিলাম, আমরা কাছাকাছি এসে পড়েছি। দিলারাম পর্যন্ত রাস্তাটা স্বাভাবিক। তারপর থেকেই অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ। খাড়া পাহাড়ি রাস্তা, চারিদিকে ঘন জঙ্গল। কোন গাছের কী নাম, কে জানে! জানার দরকারও নেই। শুধু মনে মনে ভাবছিলাম, একেবারে ঠিক জায়গাতেই এসেছি। ভিড়ভাট্টা থেকে দূরে, এমন নিস্বর্গেই তো আসতে চেয়েছিলাম।
কিছু চমক বোধ হয় তখনও বাকি ছিল। গাড়ি থেকে নামতেই চমকে গেলাম। মনে হল, কোনও এক স্বর্গরাজ্যে এসে পৌঁছেছি। চারিদিকে কী গভীর পাইনের জঙ্গল। রূপকথার মতো নীল আকাশে হিমেল মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। একেবারে নির্জন, নিশ্চুপ এক প্রকৃতি। ঠিক যেন পিকাসোর ছবি। একমুহূর্তেই সমগ্র জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেলাম। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।
কিছুটা দুশ্চিন্তা ছিল কুট্টুসকে নিয়ে। আমাদের না হয় ভাল লাগবে, কিন্তু তার ভাল লাগবে তো! চোখমুখ দেখে বুঝলাম, সেও বেশ অভিভূত। যেখানে নামলাম, সেখান থেকে একটু উঠে গেলেই তোমার বাড়ি- ডিকি হোম স্টে। রাস্তা থেকেই দেখা যায়। আমি আর কুট্টুস আমার পতিদেবকে অনুসরণ করে তোমার বাড়ি পৌঁছে গেলাম। তোমাকে একঝলক দেখেই ভীষণ ভাল লেগে গেল। তোমার সহজ সরল আতিথেয়তা আর প্রাণবন্ত হাঁসি মুগ্ধ করেছিল আমাদের।
যে ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলে, সেই ঘরটা দেখে বেশ ভাল লাগল। হয়ত পাঁচতারা হোটেলের বিলাসবহুল কক্ষ তোমার নয়, নিতান্তই সাদামাটা। কিন্তু এই অনাবিল সৌন্দর্যের কাছে ওই পাঁচতারাকেও নিতান্তই ম্যাড়মেড়ে মনে হবে। এমন এক উপত্যকা, যেখান থেকে সবদিকটা দেখা যায়, কোথাও কোনও আড়াল নেই। চারিদিকে কত প্রতিবেশী পাহাড়ের দল! কোথাও মেঘ উড়ে যাচ্ছে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের দিকে। ওই তো, একটু দূরে এয়ারফোর্স স্টেশন। রাস্তাগুলোও উপর থেকে চমৎকার দেখা যাচ্ছে। সোজা ছাদে উঠে গেলাম। বেশ খোলামেলা। চারিদিকে খোলা প্রকৃতি, মাঝে শুধু আমরা। ঘরের কথায় আসি। একঝলক দেখে মনে হল, অনেকদিন পর মায়ের কাছে গেলে মা যেমন যত্ন করে বিছানা বালিস, লেপ পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখে, তুমিও ঠিক সেইভাবেই রেখেছো।
পথশ্রমের ক্লান্তি কিছুটা ছিল। কিন্তু তোমার হাতের দারুচিনি সহযোগে চা খেয়ে সেই ক্লান্তি ভ্যানিস। এরপর আমরা নেমে এলাম প্রকৃতিরস পান করতে। সত্যিই জায়গাটা ভারি সুন্দর। ছয়দিকে ছটা রাস্তা চলে গেছে। কোনওটা একটু উঁচু, কোনওটা সমতল, আবার কোনওটা নেমে গেছে নিচের দিকে। একেকটা রাস্তায় একেকরকম সৌন্দর্য। আমরা তিনজন আপাতত একটা রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম। তোমাদের ওখানে একটা সুবিধা, পাহাড়ি রাস্তা ধরে যতদূর খুশি নেমে যাও, ক্লান্ত হয়ে গেলে কোনও না কোনও গাড়ি পাওয়া যাবে। পাহাড়কে উপভোগ করতে হলে হেঁটে ঘোরার কোনও বিকল্প নেই। কী অদ্ভুত প্রকৃতি। রাস্তার দুপাশে সুবিশাল পাইন গাছের ঘন জঙ্গল। পাইনের সংসারে সূর্যের আলোকেও প্রবেশের অনুমতি নিতে হয়। একেবারে নির্জন, নিশ্চুপ প্রকৃতি। বেশ একটা গা ছমছমে ব্যাপার। দুপুরের নরম একটা রোদ বেশ উপভোগ করছিলাম। কথা বলতেও যেন ভয় হয়। কুট্টুস মাঝে মাঝে নির্জনতা ভঙ্গ করছিল বটে, তবে আমার বকা খেয়ে সেও চুপ। বললাম, কোনও কথা নয়, পাখির ডাক শোন। গাছের মর্মর ধ্বনি আর বিভিন্ন নাম না জানা পাখির অপূর্ব কলকণ্ঠ মুগ্ধ করেছিল আমাদের। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ক্লান্ত হয়ে গেলাম। রাস্তার উপরেই বসে পড়লাম। ফেরার কোনও তাড়া নেই। মনে হচ্ছিল, এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না।
দুপুরে তোমার হাতের রান্না দারুণ লেগেছিল। আরও ভাল লেগেছিল তোমার খাবার পরিবেশনের অভিনবত্ব দেখে। নেপালি রান্না এত সু্ন্দর হয়! আগে তেমন ধারনাই ছিল না। হোটেলে আগেও খেয়েছি, কিন্তু নেপালি বাড়িতে এই প্রথম। যেমন স্বাদ, তেমনি আন্তরিকতা। খাবার পর বিশ্রাম করতে মন চাইছিল না। শীতের দেশে ঘুমোলে আর রক্ষে নেই। ঘুমিয়েই তো আমাদের অর্ধেক জীবন কেটে গেল। তাই ভাবলাম চারপাশটা ঘুরে দেখি। আবার নিচে নেমে এলাম। এবার ধরলাম চটকপুর দিকে যাওয়ার রাস্তা। মোটামুটি সমতল, কোনও চড়াই উতরাই নেই। তাই নিশ্চিন্তে হাঁটা যায়। প্রতি বাঁকে যেন মুগ্ধতা। আরও গভীরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সন্ধে নামার আগেই ফিরতে হবে, তাই ফিরে আসতে হল। মনে হচ্ছিল, এত সুন্দর একটা জায়গা, পর্যটকরা হদিশ পায়নি? আর তো কোনও পর্যটককে দেখলাম না। পরে মনে হল, যারা শপিং মল খোঁজে, যারা চাইনিজ রেস্তোরাঁ খোঁজে, তাঁদের জন্য এই জায়গাটা নয়। যারা প্রকৃতিকে অনুভব করতে জানে, নির্জনতার মর্ম বোঝে, এটা শুধু তাদের জন্যই। বেরসিক টুরিস্টের সংখ্যা যত কম হয়ত, ততই ভাল।
ইতিমধ্যে তোমার শেরুও আমাদের দারুণ বন্ধু হয়ে গেছে। কী সুন্দর দেখতে ওকে। তোমার কল্যাণে ওর চেহারাটিও বেশ নাদুস নুদুস। আমরা কাছে গেলেই ও লেজ নাড়াচ্ছে। কুট্টুসের সঙ্গে ওর দোস্তিরা একটু বেশি। তোমার বাড়ির নিচে যে প্রাইমারি স্কুলটা আছে, দুপুরে ভাবলাম সেখান থেকে ঘুরে আসি। সেখানে গিয়ে দেখলাম, গুটিকয়েক ছানাপোনা। আর দুএকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা। আমরা কাছে যেতেই সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। একজন শিক্ষিকাকে বললাম, এরকম স্বপ্নের মতো সাজানো একটা ছোট্ট স্কুল দেখে মনে হচ্ছে আবার ছোট হয়ে যাই। ওদের সঙ্গে আবার এই স্কুলে পড়ি। কী সুন্দর বাচ্চাগুলো। স্কুলে গ্যাসের ব্যবস্থা নেই। উনুনই ভরসা। তাই সকালবেলায় দেখতাম, বিভিন্ন পাহাড় থেকে হাতে একটা করে গাছের ডাল নিয়ে ওরা নেমে আসছে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
-ইয়ে ক্যা হ্যায়?
– ইয়ে লকড়ি হ্যায়।
-ক্যা করোগে ইসকো লেকার?
-স্কুল মে খানা পাকানেকে লিয়ে।
দুপুরবেলায় একটা ঘরের মধ্যে দশ বারোজন খেতে বসেছে। সবার বয়সই ছয়ের নিচে। সাদা ভাতের ওপর তরকারির রঙ বেশ লাল। দেখেই বুঝলাম, ব্যাপক ঝাল। আর বাচ্চাগুলো ঝালের চোটে হু হা করছে। তবুও খাচ্ছে। আমাদের এখানের বাচ্চাদের সঙ্গে কী বৈপরীত্য।
বেশ রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশ ছিল। হঠাৎ দেখি রোদ ভ্যানিস। তার বদলে কুয়াশার চাদর আমাদেরকে ঢেকে দিয়ে গেল। সঙ্গে হিমেল বাতাস। ঘন সবুজ পাইন গাছের ভেতর দিয়ে ভেসে আসছে মেঘ। সে কী স্বর্গীয় দৃশ্য। মনে পড়ে গেল শক্তি চাটুজ্জে্র সেই কবিতা, এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে। লাইনটা আগেও শুনেছি, পড়েছি। কিন্তু এমনভাবে অনুভব করিনি কখনও।
তোমাদের দেখে খুব হিংসে হয় আন্টি। তোমরা এত সুন্দর একটা জায়গায় থাকো। প্রকৃতি তার এই অপরূপ ঐশ্বর্য তোমাদের দিয়েছে। যা থেকে আমরা বঞ্চিত। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি, কী কষ্টের তোমাদের জীবনযাত্রা। প্রতিমুহূর্তে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে তোমাদের দিন কাটে। আর আমরা, দুদিনের জন্য শখের অতিথি।
পরের দিন প্রাতভ্রমণে কুট্টুস যেতে চাইল না। এত ভোরে ওকে জোর করে তুলতে ইচ্ছেও করল না। অগত্যা, কাকভোরে আমি আর আমার পতিদেব। সঙ্গে আমাদের লোকাল ট্যুর গাইড শেরু। চারটে রাস্তার তিনটেতে ঘোরা হয়ে গিয়েছিল। একটাই বাকি ছিল। একটু একটু করে আলো ফুটছে। পাহাড়ের ভোরটা সত্যিই চমৎকার। যারা ভোরে এই নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটেনি, তারা জানতেও পারে না, তারা কতকিছু হারাল। নির্জন সেই রাস্তা ধরে হাঁটছি তো হাঁটছি। কোথাও বসছি। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছি। কখনও বা নির্জন প্রকৃতিতে প্রেমালাপ, একটু দুষ্টুমি, একটু খুনসুটি। তার মধ্যেই লক্ষ করলাম, শেরুও আমাদের সঙ্গে অনেকদূর চলে এসেছে। বারবার ফিরে যেতে বলা সত্ত্বেও গেল না। রাস্তাটা খুব ঢালু ছিল। যার ফলে নেমে যাওয়াটা সহজ। কিন্তু ওঠা বড়ই মুশকিল। কী করা যায়! আমরা তো না হয় হাত তুলে যে কোনও একটা গাড়ি ধরে উঠে যেতে পারব। কিন্তু বেচারা শেরু, এতটা পথ একা একা কীভাবে যাবে? মানুষ জাতটা বড়ই বেইমান। আত্মগ্লানি যে হচ্ছিল না, তা নয়। তবুও আমরা নিরুপায় হয়ে একটা গাড়িতে চেপে ফিরে এলাম। শেরু সেদিন যথার্থই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছিল। ওইরকম নির্জন রাস্তায় আমাদেরকে একা ছেড়ে দিতে চায়নি। কিন্তু আমরা ওর মর্যাদা রাখিনি। নিচের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখলাম শেরু হাঁপাতে হাঁপাতে উপরে উঠে গেল। অনেকবার ডাকলাম, তাকাল না। বিস্কুট দিলাম, খেল না। নীরব প্রতিবাদ? হতেও পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। পরে অবশ্য ওর অভিমান ভাঙল। আমাদেরও অপরোধবোধ আর গ্লানি কিছুটা কমল।
আরও একদিন থাকতে পারলে ভালই হত। কিন্তু পরেরদিন চলে এলাম লেপচা জগৎ। সারাদিন শুধু বৃষ্টি। কুট্টুসেরও মন খারাপ। সেও বারবার তোমার কাছে ফিরে যেতে চাইছিল। ওইটুকু বাচ্চা ছেলেও হয়ত তোমার মধ্যে মাতৃত্বের ভালবাসা খুঁজে পেয়েছিল। সন্ধেবেলায় ওরকম বৃষ্টিস্নাত ঠান্ডার মধ্যে তোমার হাতের গরম মশলা দেওয়া চা আর পকোড়া খুব মিস করি। রাত্রিবেলায় মুরগির ঝোল আর ভাতের কথাও খুব মনে পড়ে। মোবাইল স্ক্রিনে মাঝে মাঝেই বাগোড়ার সেই ছবিগুলো দেখি। তোমার মুখটাও মনে পড়ে যায়।
আবার কখন পাহাড়ে যাব, জানি না। যদি যাই, ভিড়ে ঠাসা দার্জিলিং বা গ্যাংটক নয়। তোমার কাছেই যাব।
ভাল থেকো।
2 comments
Writer ke dhonyobad.. khoroch kirokom ar kibhabe book kora jay janale upokar hobe
Address & contact no.for Bagora please.