দার্জিলিং ম্যানিয়াক (দ্বিতীয় পর্ব)

 

সন্দীপ লায়েক

প্রথমেই বলে রাখি নেহাত নিরুপায় না হলে আমি হুটোপুটি করে বেড়ানো পছন্দ করি না। কোথাও বেড়াতে গেলে সব জায়গা কভার করে আসতেই হবে এমনও কোনও কথা নেই। কোনও জায়গা ভালো লেগে গেলে দিব্যি ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারি আবার ভালো না লাগলে উল্টোটাও হয়ে থাকে।
যাইহোক প্রথমদিন দুপুরে যখন দার্জিলিং-এর হোটেলে পৌঁছলাম দুপুর তখন দেড়টা। লাঞ আগে হতেই বলা ছিল হোটেলে। ইসদূ্ষ্ণ গরম জলে নিজেকে সমর্পণ করে, লাঞ্চ সেরে নিতে দুপুর আড়াইটা বাজলো। মৌরি চিবুতে চিবুতে উঠে এলাম হোটেলের ব্যলকনিতে। কিছুক্ষণ সেখনে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দার্জিলিং এর উপত্যকায় ধাপে ধাপে বাড়িঘর, পাইন গাছের সারি ও দূরে হাল্কা কুয়াশা মাখা উপত্যকা দেখতে দেখতে কয়েক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে ফেললাম নিজেকে।
নাহ। এবার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। পথের সমান্য ক্লান্তিটুকু দূর করতে তুলতুলে বিছানায় এলিয়ে দিলাম নিজেকে। প্রথমে বিছানাটা বড্ড স্যঁাতস্যঁাতে মনে হলেও কিছুক্ষণ পর সেটা যেন স্বাভাবিক হয়ে এল।
ঘড়ির কাঁটায় ডট বিকেল চারটে বাজতেই গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে পড়লাম চৌরাস্তা ম্যালের দিকে। এই ম্যালটাই হল এ শহরের প্রাণকেন্দ্র। সে সময় বিখ্যাত নেপালী কবি ভানু আচার্য্য, যিনি সংস্কৃত থেকে নেপালী ভাষায় রামায়নের অনুবাদ করেছিলেন তার মূর্তির পিছনের সুন্দর বাগানটা ভেঙে কংক্রিটায়ন চলছে।
হাওয়াঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের সৌন্দর্য্য আর মানুষজনের আনন্দ দেখতে দেখতে একসময় বিকেল গড়িয়ে পাহাড়ে সন্ধ্যে নামলো। নেহেরু রোডের সঙ্গে ম্যালের মিলনক্ষেত্রে থাকা জলের ফোয়ারাটা ততক্ষণে দাপাদাপি শুরু করেছে। সেদিন সারাটা বিকেল কেমন করে যে কেটে গিয়েছিল তার কোন হিসেব আমার কাছে নেই।
যাই হোক যেখানে এসেছি সেখানের খাবার পরখ করব না তাই আবার হয় নাকি? ফুটপাথের একটা দোকান থেকে দুটো লিটটি কিনে নিলাম, স্বাদ বেশ ভালো।
পৃথিবীর প্রতিটি স্থানের দিন ও রাত্রের রূপ সম্পূর্ণ আলাদা। তাই আরও কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে রাত্রির শহরটাকে ভালো করে দেখে চোখে জড়িয়ে নিয়ে, উনুনে সেঁকা লেবু-লবণ মেশানো ভুট্টোতে কামড় দিতে দিতে ধীর ছন্দে হাঁটা দিলাম হোটেলের দিকে।

দ্বিতীয়দিন :-
—————-
আমাদের দ্বিতীয় দিনটা ছিল শুধুমাএ টয়ট্রেন যাত্রা ও বিকেলে শীতবস্ত্র কেনাকাটার জন্য বরাদ্দ। সকালে স্নান সেরে আটটায় বেরিয়ে হাঁটা দিলাম দার্জিলিং স্টেশনের দিকে। ম্যাল থেকে নেহেরু রোডের ঢালু পথ বেয়ে প্রায় মিনিট পনেরোর মতো পথ। ডানদিকের নাম না–‌জানা নানান গলিগুলো কোথায় যেন নীচে মিলিয়ে গেছে!
ম্যাল থেকে কিছুটা নেমেই প্রথমে পড়ল গ্লেনারীজ। সেখানে Tosted Bread সঙ্গে Peanut Butter, ডিমের পোচ সঙ্গে দার্জিলিং চা খেয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। আমরা বসলাম ঠিক সেই টেবিলটায় যেটাতে শুটিং হয়েছিল টেলিফিল্ম দার্জিলিং দার্জিলিং। চা যে এত আকর্ষক পানীয় হতে পারে গ্লেনারিজেই প্রথম বুঝেছিলাম।

darjeeling10
খাওয়া সেরে বেরিয়ে এলাম একশো বছরেরো বেশি সময়ের ঐতিহ্যশালী গ্লেনারিজ রেস্টুরেন্ট থেকে। আরও নীচে নামতে নামতে চৌমাথায় দেখা দিল আরো একটি ঐতিয্যশালী রেস্টুরেন্ট ক্যাভেনটার্স। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, গ্লেনারিজ এবং ক্যাভেনটার্স-এ বিলিতি ব্রেকফাস্ট না সারলে দার্জিলিং ভ্রমণের দাবিদার হওয়া যায় না।
ক্রমে দার্জিলিং স্টেশনে যখন পৌছলাম, টয় ট্রেন আমাদের জন্য অপেক্ষারত। কপাল ভালো, আমরা স্টীম ইঞ্জিনটাই পেয়েছিলাম, ডিজেলটা নয়! আমার স্বপ্নের রানী টয় ট্রেনে চড়ার স্বপ্ন তখন বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। ট্রেন ছাড়লো কু.. কু..ঝিকঝিক শব্দ করে ধুঁয়া উড়িয়ে, যে শব্দ এতকাল শুনে আসছি লোককথায় কিম্বা দেখে আসছি সিনেমার পর্দায়। গায়ে এসে পড়তে লাগলো গরম কয়লার গুঁড়ো। পথচারীরা ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে দুহাত নেড়ে আমাদের আনন্দ কয়েকগুন বাড়িয়ে দিলেন।
শহরের ভেতর দিয়ে নানা বাঁক দিয়ে গড়িয়ে চলল ট্রেন। একসময় ট্রেন বাতাসিয়া লুপে এসে পৌঁছলো। কিছুক্ষণ বিরতি। আমরা ক্যমেরা নিয়ে নীচে নেমে এলাম।
অদ্ভুত সুন্দর একটি বৃত্তাকার পথ এই বাতাসীয়া। চারিদিকে সাজানো ফুল ও নানাবিধ সাজানো গাছ। চালক ও তার সহকারী নেমে এসে ইঞ্জিনে কয়লা ভরতে লাগলেন, আর আমরা চললাম ভারতীয় সেনাবহিনীর গোর্খা মেমোরিয়ালের দিকে। হঠাৎই দূরে চোখ তুলে তাকাতেই দেখি মেঘ সরিয়ে উঁকি মারছে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা।

batasia loop
মিনিট দশ বিরতির পর যাত্রা আবার শুরু। কিছুক্ষণ পর ঘুম স্টেশনে পৌঁছলাম। ঘুম স্টেশন হল এদেশের সর্বোচ্চ রেলওয়ে স্টেশন (আগে পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্টেশন ছিল)। ট্রেন এখান থেকে আবার ফিরে আসবে দার্জিলিং স্টেশনে। হাতে সময় কুড়ি মিনিটের মতো।
মডেল ট্রয়ট্রেনের পটাপট ছবি তুলে উঠে এলাম দোতলায়। সেখানে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে ইন্ডিয়ান হিমালয়ান রেলওয়ের ঐতিহ্যশালী ট্রয়ট্রেন মিউজিয়াম দেখে নিলাম। একটু চা, সিঙাড়া খেয়ে আবার টয় ট্রেনে উঠে বসতেই ট্রেন ছাড়লো। আবার ফিরে এলাম সেই বাতাসিয়া ছুঁয়ে দার্জিলিং।
এরপর খাড়াই ভেঙে এগিয়ে চললাম হোটেলের দিকে। যে রাস্তা পনের মিনিটে হেঁটে এসেছিলাম সেটাই উঠতে লাগলো প্রায় আধঘন্টা। পথের মাঝে ডানদিকের একটা দোকানে লাঞ্চ সেরে দুটো দুলিটারের বিসলারি বোতল নিয়ে এগিয়ে চললাম। আসলে হোটেলে নাম নাজানা কোম্পানির এক লিটার জলের বোতল ছাড়া কিছুই মেলে না।
আবার কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে বিকেলে উল্টোপথ দিয়ে বেরোলাম ম্যালের দিকে। শহরটাকে হেঁটে ঘেঁটে দেখতে হবে তো! সন্ধ্যে নামতে দরদাম করে কিছু টুকটাক শীতবস্ত্র কিনলাম, দাম যদিও কম নয় তবুও স্রেফ স্মৃতি হিসেবে।

দার্জিলিং ম্যানিয়াক। প্রথম কিস্তির লিঙ্ক। এখানে ক্লিক করলেই সেই লেখাটি পড়তে পারবেন।

https://www.bengaltimes.in/19198-2/

(‌দার্জিলিংকে ঘিরে নস্টালজিয়া। এমনই নস্টালজিয়া আপনার ভেতরেও থাকতে পারে। জায়গাটা দার্জিলিংও হতে পারে। অন্য কিছুও হতে পারে। মেলে ধরুন আপনার অভিজ্ঞতা। পৌঁছে যাক বেঙ্গল টাইমসের হাজার হাজার ভ্রমণ পিপাসু পাঠকের কাছে। সঙ্গে ছবিও পাঠাতে পারেন। লেখা ও ছবি পাঠানোর ঠিকানা— bengaltimes.in@gmail.com)

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *