সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
তাজমহল দেশদ্রোহীদের তৈরি। তাজমহল ভারতবর্ষের কলঙ্ক। তাজমহলের রূপকার ছিলেন হিন্দু নিধনকারী। এমন অভাবনীয় অভিযোগ শুনলেই বোঝা যায়, অভিযোগকারী কোন নীতিতে বিশ্বাসী হতে পারেন ? হ্যাঁ, তিনি উত্তরপ্রদেশের বিধায়ক সঙ্গীত সোম এবং সেই তথাকথিত “জাতীয়তাবাদী” দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির দলভুক্ত।
এই ধরণের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানানো খুবই কষ্টকর এবং সুস্থ রুচির পরিপন্থী। কারণ এ তো আর প্রথম নয়, বিগত সাড়ে তিন বছরে এই জাতীয় মন্তব্য প্রতি মাসেই বেশ কয়েকবার বেরিয়ে আসে। টিভি চ্যানেলে বা কাগজে ফলাও করে তা প্রচারও করা হয়। বলা বাহুল্য, সবকটিই বর্তমান কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ থেকে শুরু করে নীচুস্তরের নেতাদের এবং বিজেপির শাখা সংগঠন আর.এস.এস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতাদের মুখনিঃসৃত। খোদ প্রধানমন্ত্রীও ও এর ব্যতিক্রম নন। তিনিও প্রকাশ্যে হিন্দু দেবতা গণেশের হাতির মাথাকে প্লাস্টিক সার্জারী বলে দেন বা গাছ-পালা তথা উদ্ভিদজগৎ যে উত্তেজনায় সাড়া দেয়, সেটি বিজ্ঞানের আবিষ্কারের আগেও নাকি গীতাতে লিখিত ছিল—একথা মনে করেন। স্বভাবতই তাঁর দলের অন্যান্য মন্ত্রীরা বা নেতারাও তারই দেখানো পথ অনুসরণ করবেন—এ আর আশ্চর্য কি? তাঁরই মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তথা বর্তমানে দেশের স্বরাস্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং জনসমক্ষে বলেন, ‘গরুর মধ্যে ৮০% হল মানুষের আত্মা’। বিজেপি পরিচালিত রাজস্থানের শিক্ষামন্ত্রী বাসুদেব দেবনানী মনে করেন, প্রাণীজগতের মধ্যে গরুই একমাত্র অক্সিজেন ত্যাগ করে। সেই রাজস্থানেই আবার ইতিহাস বই থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় “মুঘল যুগ” বাদ দেওয়া হয় শুধু ধর্মান্ধতার বশবর্তী হয়ে। আর উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে তিন চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই রাজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করার লক্ষ্যে সে রাজ্যের নব মুখ্যমন্ত্রী তথা উদগ্র হিন্দুত্ববাদের হিংস্র মুখ যোগী আদিত্যনাথ আগ্রায় ভারতীয় স্থাপত্য ও শিল্পকলার সর্বাপেক্ষা গরিমাময় নিদর্শন সেই “তাজমহল” কেই সে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্র থেকে বাদ দিয়ে দেন। সেই উগ্রতার আরও এক দৃষ্টান্ত মুঘলসরাই রেলস্টেশনের নামই বদলে ফেলার নির্দেশ । গুরুত্বপূর্ণ সেই রেলস্টেশনের নাম হয় একদা স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কর্মী দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে।
এরকম উদাহরণ অজস্র আছে। উত্তরপ্রদেশের ফতেপুরের সাংসদ সাধ্বী নিরঞ্জনা জ্যোতির মুখে রামজাদে অথবা হারামজাদে শোনা গিয়েছিল। উন্নাও এর সাংসদ সাক্ষী মহারাজের তো অশালীনতায় জুড়ি মেলা ভার। তিনি একাধারে ভারতীয় হিন্দু নারীদের কমকরে পাঁচটি সন্তান জন্ম দেওয়ার নিদান দেন। অপরদিকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ পেয়ে এক হতভাগিনী মহিলার অন্তর্বাস খোলার নির্দেশ দেন। কখনও তিনি ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত রামরহিম বাবার সাফাই দেন তো কখনও তাকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য দেশের আইনকানুন ও বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ পীঠস্থান মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এর বিরুদ্ধেই বিষোদ্গার করেন। রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, গুজরাট—বিজেপি শাসিত এই সব রাজ্যে দৈনন্দিন চলেছে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন থেকে খুন, দলিতদের ওপর অকথ্য অত্যাচার আর গোরক্ষকদের তান্ডব।
বস্তুতঃ ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে উত্তরপ্রদেশের বিধায়ক সঙ্গীত সোমের এই মন্তব্যে আমি একটুও বিস্মিত নই, তা যতই শ্রীহীন, রুচিহীন হোক না কেন। এই অর্বাচীন, নির্বোধ,হিংস্র, বর্বর, ধর্মান্ধরা জানে না দেশের গৌরব, দেশের গরিমা, দেশের স্থাপত্যশিল্পের উৎকর্ষের সর্বাপেক্ষা সমুজ্জ্বল নিদর্শন হল আগ্রায় যমুনাকিনারে নির্মিত এই তাজমহল। প্রতিবছর দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে তো বটেই ভারতের বাইরের বহু দেশ থেকে বহু মানুষ প্রেমপ্রীতির এই অনন্য স্মৃতিসৌধ দেখতে আসেন। দেশের পর্যটন শিল্পের প্রসারে বিগত কয়েক শতাব্দী ধরেই তাজমহল সর্বাগ্রগণ্য। তার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, তার শ্বেতমর্মরে গাথা বিরহ বেদনার এই ইতিহাস আজও সারা বিশ্বের কাছে এক বিপুল বিস্ময়। শুধু ধর্মান্ধতার কারণে সেই প্রেমসৌধকে কালিমালিপ্ত করার অপচেষ্টা শুধু নিম্নরুচির পরিচায়কই নয়, তা দেশের সভ্যতা সংস্কৃতির গায়েই কাদা ছেটানো।
আমার তাই একটাই প্রশ্ন। এই হিংস্র, বর্বর দল এবার কি সেই মুঘল আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক লালকেল্লাকেও “দেশদ্রোহী”দের নির্মিত আখ্যা দেবে এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবসে সেই লাল কেল্লা থেকে তেরঙা পতাকা উত্তোলনের রীতিকেও রাতারাতি বদলে দেবে ?