(আজ ব্যারেটোর জন্মদিন। ঠিক দু বছর আগে, এই দিনেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁকে নিয়ে একটি বিশেষ লেখা। ব্যারেটোকে লেখা সেই খোলা চিঠি। আবার প্রকাশিত হল। লিখেছিলেন ময়ূখ নস্কর। অনেকেই পড়েননি। পড়ুন, ভাল লাগবে। )
প্রিয় ব্যারেটো,
চিঠিটা আরও আগেই দিতে পারতাম। কিন্তু ভাবলাম, নতুন শহরে গেছ, ঘর-দোর গোছাতে ক’দিন সময় তো লাগবে, এর মধ্যে আর পুরানো কথা তুলে তোমার মন খারাপ করাব না।
আশা করি, এই কদিনে সবকিছু গুছিয়ে নিতে পেরেছ। হয়তো ভেরোনিকা আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে নতুন শহরটা ঘুরেও দেখেছ। শহরটাকে তো চিনে নেওয়া দরকার। অবশ্য মুম্বইতে তুমি আগেও থেকেছ, সেই মাহিন্দ্রাতে খেলার সময়, তবে সেটা যে একটা ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার, সেটা তুমিও জানতে, আমরাও জানতাম। আমরা জানতাম, তুমি আবার কলকাতায় ফিরে আসবে। এবং এলে অন্য কোথাও নয়, খেলেব আমাদের মোহবাগানেই। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। এবার…।
মুম্বই কেমন লাগছে ব্যারেটো ? সুন্দর ? কলকাতার থেকেও সুন্দর ? জানি, কলকাতায় ভালো লাগার মতো কীই বা আছে ! মুম্বই কত বিলাসবহুল, কত কর্মচঞ্চল, দেখার মতো কত জায়গা। ছুটির দিনগুলোতে বাচ্চাদের নিয়ে মাঝে মাঝে মেরিন ড্রাইভ থেকে ঘুরে এসো, ওরা খুব মজা পাবে। আমাদের কলকাতায় গঙ্গার পাড় আছে, সমুদ্র তো নেই।
জানো, ওই মেরিন ড্রাইভে অনেক সিনেমার শুটিং হয়, অনেক গানের। একটা গানের কথা খুব মনে পড়ছে। অনেক পুরানো গান। পরনের কোটটাকে কাঁধের ওপর আলগোছে রেখে, মেরিন ড্রাইভ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন দেবানন্দ। আরব সাগরের হাওয়ায় তাঁর চুল উড়ছে, আর পিছনে একা পথে গায়ক আর তাঁর সঙ্গিনী গাইছেন,
লেকে পহেলা পহেলা প্যায়ার,
ভরকে আঁখো মে খুমার
জাদু নগরী সে আয়া হ্যায় কোই জাদুগর,
লেকে পহেলা পহেলা প্যার …
হঠাৎ এই গানটার কথা মনে এল কেন বল তো ? তোমার জন্য। তোমার কথা মনে এলেই আমার এই গানটা মনে আসে। জাদু নগরী সে আয়া হ্যায় কোই জাদুগর…
আমরা সবাই, মানে মোহনবাগানিরা এখন খুব ব্যস্ত জানো। দলবদল চলছে। বেলো তো হাতছাড়া হল, বলবন্ত থাকবে কি থাকবে না ?
ফরোয়ার্ডে নতুন বিদেশি কে আসবে ? কাটসুমি না হয় থাকছে। সোনি শেষপর্যন্ত থাকবে তো ? ফেসবুকের সামনে কেটে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রতিবারই এমনটা হয়। হওয়াটাই নিয়ম। চ্যাম্পিয়ন হব কি হব না ? অবনমন আটকানো যাবে কি না? নতুন বছরের টিম কেমন হবে ? নানা উৎকণ্ঠায় দুলতে দুলতে সময় কেটে যায়। কেটে যায় ১৭ টা বছর।
১৭ বছর! হ্যাঁ, ১৭ বছর আগে এমনই দলবদলের সময়ে তুমি কোন ‘জাদুনগরীর জাদুকর’ আমাদের এই শহরে এসেছিলে। প্রথমে বুঝতে পারিনি কোন অতিথি আমাদের ঘরে এলো। তখনও আমাদের ডায়মন্ড সিস্টেমের ঘোর কাটেনি, চিমা- বিজয়নের ঘোর কাটেনি, সেবার আমাদের টিমে ইগর- স্টিভনের- মতো তারকা। তাই ১০ নয়, ৮ নম্বর জার্সি পরে মাঠে নামল কোথাকার কে এক ব্রাজিলীয় ব্যারেটো।
তখনও আমাদের হাতে হাতে মোবাইল ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ তো দূরের কথা, অর্কুটও তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। তাই তোমার আগমন নিয়ে কোনও চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়নি, উইকিপিডিয়া, ইউটিউব থেকে কোনও লিঙ্ক শেয়ার করা হয়নি। কিন্তু কদিন যেতে না যেতে যা হল, তা আমাদের ক্লাবে কোনওদিন হয়নি। আর আমাদের ক্লাবে হয়নি মানে ভারতের কোনও ক্লাবেই হয়নি।
‘ঘরের ছেলে’ আমাদের অনেক আছে। বাঙালি ‘ঘরের ছেলে’, অবাঙালি ‘ঘরের ছেলে’। কিন্তু বিদেশ থেকে এসে কেউ কখনও আমাদের ‘ঘরের ছেলে’ হয়নি। ভালো আমরা অনেককেই বেসেছি, কিন্তু ভালবেসে কাউকে ‘সবুজ তোতা’ বলে ডাকিনি। ভরসা তো অনেককেই করেছি। কিন্তু শীত-গ্রীষ্ম- বর্ষা বছরের পর বছর তোমার মতো ভরসা কেউ দেয়নি। আর কাউকে আমরা ‘আমাদের যিশু’ বলে মনে করিনি। খেলার মাঠে মহানায়ক তো আমরা অনেক দেখেছি, কিন্তু তাদের কারোর জন্মদিন আর আমাদের সিনেমার মহানায়কের জন্মদিন একই দিনে (৩ সেপ্টেম্বর) ছিল না।
একবার একটা কাণ্ড হয়েছিল। আমার এক দাদু, মোহনবাগানের সাপোর্টার, কিন্তু কোনওদিন মাঠে খেলা দেখতে যায়নি। ২০০১-০২ মরশুমে যুবভারতীতে সালগাঁওকার ম্যাচে আমি দাদুকে নিয়ে গেলাম। বোধহয় কার্ড সমস্যার জন্য তুমি ম্যাচটায় খেলতে পারনি। ভিভিআইপি এনক্লোজারে বসেছিলে। আমার দাদু জীবনে প্রথমবার মাঠে গিয়ে খেলা না দেখে হাঁ করে শুধু তোমাকে দেখেছিল। এমনই ছিল তোমার প্রতি সেই বুড়োর ভালোবাসা।
তোমার ফেয়ারওয়েল ম্যাচে সবাই যখন গেটের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে তোমাকে একবার দেখবে বলে, একটা বাচ্চা ছেলে ফাঁক গলে দৌড় লাগল ড্রেসিং রুমের দিকে। পুলিশকর্মী খপ করে তার হাত ধরে ফেলে বললেন ”এমন বাম্বু দেব না!” অকুতোভয় ছেলেটি সেদিন বলেছিল, “দিন। ব্যারেটোকে দেখার জন্য বাম্বু খেতে পারব না?”
ব্যারেটো, মুম্বইতে কেউ তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে? কেউ ছুটে যায়?
আমরা যেতাম। তোমার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তো শুধু খেলোয়াড় আর সমর্থকের সম্পর্ক ছিল না। একবার ফোর্ট উইলিয়ামের কাছে তোমার গাড়িতে অন্য একটা গাড়ির ধাক্কা লেগেছিল। সামান্য ধাক্কা, কলকাতা শহরে রোজ এমন অনেক হয়। কিন্তু যেই দেখা গেল গাড়ি থেকে তুমি নামছ, সারা গড়ের মাঠের দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছু হয়নি তো?
সেই যেবার সাও পাওলোগামি বিমানে দুর্ঘটনা হল, তুমি তখন ব্রাজিলের উদ্দেশে রওনা হয়েছ, সমর্থক থেকে সাংবাদিক সবার কি উৎকণ্ঠা ! ওরে, একবার খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, কিছু হয়নি তো?
যেবার দমদম বিমানবন্দরে পুলিশ তোমাকে জেরা করল, খবরেরর কাগজের অফিসে ফোন করে তোমার এক ভক্তের কি কান্না! “দাদা, ব্যারেটোর কিছু হয়নি তো?” পরের দিন আদালতেও যেন জনসমুদ্র। শুধু মোহনবাগান নয়, ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরাও সেদিন ভিড় করেছিল আদালতে। তাঁরাও বারবার চাইছিলেন, ব্যারেটো নির্দোষ, তাঁর যেন কিছু না হয়। আমার এক বন্ধু আছে, কট্টর ইস্টবেঙ্গলি। সে মোহনবাগানের সবার নামে খিস্তি দেয়, মা মাসি উদ্ধার করে। প্রথম প্রথম তোমাকেও দিয়েছিল। কিন্তু দু তিন বছর পর দেখছি, সে তোমার নামে কোনও খারাপ কথা বলছে না। একদিন জানতে চাইলাম, ব্যারেটোর নামে তো খারাপ কথা বলিস না। সে নিজের কান মুলে বলল, আগে দিতাম, ভুল হয়ে গেছে। তখন ওকে চিনতে পারিনি। এখন চাইলেও আর পারব না। ওর মুখটা মনে পড়লে খিস্তি আসে না।
এই দমদম বিমানবন্দরে তোমাকে নিয়ে আমাদের কত হাসি কান্নার স্মৃতি। প্রথম যখন এলে, আমরা কেউ স্বাগত জানাতে যাইনি। আসলে তখন তো বুঝতে পারিনি তুমি আমাদের কে? বুঝিনি, তুমি আসলে আমাদের গতজন্মের ভাই, কত বিকেল তোমার সঙ্গে কাঠের গ্যালারিতে বসে মোহনবাগানের খেলা দেখেছি। বুঝিনি, ভেরোনিকা নামের ওই মেয়েটি, যে সবুজ মেরুন জার্সি পরে মাঠে আসে, একগাল হেসে আমাদের থেকে ক্লাবের পতাকা চেয়ে নেয়, সে শুধু তোমার বউ নয়, আমাদের মতই কোনও মোহনবাগানি পরিবারের মেয়ে, ভুল করে ব্রাজিলে জন্মেছে। বুঝিনি বলে প্রথম দিনে বিমানবন্দরে তোমাকে স্বাগত জানানো হয়্নি।
কিন্তু ২০০২-তে যখন গোয়া থেকে জাতীয় লীগ জিতে ফিরলে এই বিমানবন্দরেই দেখিয়ে দিয়েছিলাম ভালোবাসা কাকে বলে। যেদিন অভিমান করে তুমি ক্লাব ছেড়ে চলে গেলে, সেদিন এই বিমানবন্দরেই আমরা চোখের জলে ভেসেছিলাম। তার আগে তোমার কসবার ফ্ল্যাটের বাইরে কত সমর্থক দিনরাত এক করে ধরনা দিয়েছিল, “যেও না ব্যারেটো।”
কিন্তু এবার! তুমি যখন কলকাতা ছাড়লে, আমাদের কী ভুলো মন, কেউ দমদমে গেলাম না, কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেললাম না, কেউ বললাম না, “যেও না ব্যারেটো।”
দুঃখ কোরো না ব্যারেটো। আমাদের আদরের সবুজ তোতা। জীবন এই রকমই, আমরা সবাই এখন খুব ব্যস্ত। দলবদলের বাজারে আমরা নতুন নায়ক খুঁজছি। যারা নতুন, তারা হয়তো তোমাকে ভুলে গেছে। কিন্তু ভাই, আমরা যারা তোমার খেলা দেখেছি, তোমাকে দেখেছি, ভালবেসেছি, জীবনেও ভুলব না।
যদি আর এই শহরে না আসো, যদি অনেক বছর পর কখনও মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভে তোমার সঙ্গে দেখা হয়, হয়তো তখন তুমি বৃদ্ধ, আমার চুলেও পাক ধরেছে, ঠিক চিনতে পারব ব্যারেটো। ঠিক পারব। তরুণ বয়সের আবেগে চেঁচিয়ে উঠব, “শীত-গ্রীষ্ম- বর্ষা… ”। চৌপাত্তি বিচের পাওভাজি বিক্রেতা হয়তো চমকে উঠবে, ভাববে বুড়োটা এমন চেঁচায় কেন? সে তো আর জানে না তুমি কে? কিন্তু আমরা তো জানি, তুমি জাদুনগরীর জাদুকর।
লেকে পহেলা পহেলা প্যায়ার,
ভরকে আঁখো মে খুমার
জাদু নগরী সে আয়া থা এক জাদুগর…
ভালো থেকো, মাঝে মাঝে এসে মোহনবাগানকে আর মোহনবাগানিদের দেখে যেও, ইতি…