প্রসূন মিত্র
পাছে কেউ প্রাদেশিক বলে! সবসময় যেন এমন একটা আতঙ্ক আমাদের তাড়া করে বেড়িয়েছে। নিজের ভাষাকে ভালবাসা মানে প্রাদেশিকতা নয়, এই সহজ বিষয়টা আমরা বুঝতে চাইনি। তাই আজ কলকাতায় বাংলা ক্রমশ নির্বাসিত হতে বসেছে। রাস্তায় ঘুরুন, ট্যাক্সিতে চড়ুন, সিনেমা হলে টিকিট কাটতে যান। আপনার মনেই হবে না, আপনি বাংলায় আছেন। হিন্দিতে প্রশ্ন আসবে। আপনাকে হিন্দিতেই উত্তর দিতে হবে। আর আপনিও পরম গর্বে হিন্দিতে উত্তর দিয়ে চলেন। অন্যদের হয়ত দেখাতে চান, আপনি কত ভাল হিন্দি বলেন।
একবারও ভেবে দেখেছেন, এই কলকাতা শহরে আপনাকে সারাদিন এত হিন্দি বলতে হয় কেন? যাঁরা বাইরে থেকে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে তবু না হয় হিন্দিতে বলা যায়। কিন্তু যে এই বাংলাতেই জন্মেছে, এই কলকাতাতেই যার এতগুলো বছর কেটেছে, সে বাংলা বলবে না কেন? তার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলতে হবে কেন? কলকাতার অধিকাংশ সাইনবোর্ডে বাংলা থাকবে না কেন?
এই নিয়ে প্রায় দুই দশক আগে একটা আন্দোলন হয়েছিল। শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে কিছুটা সাড়াও পড়েছিল। তারপর যা হয়! সময়ের নিয়মে সেইসব মঞ্চ, আন্দোলন থিথিয়ে যায়। কলকাতায় আবার সেই হিন্দিভাষীদেরই দাপট। কোণঠাসা হতে হতে বাংলা ভাষা প্রায় নির্বাসিত হতে চলেছে।
আগেও সরকার এই ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। আমি কোনও কালেই তৃণমূলপন্থী নই। হওয়ার প্রশ্নও নেই। তবে এই একটা ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি। হ্যাঁ, সব স্কুলে বাংলা চালু করতে হবে। যদি জোর করে হয়, তবে তাই। বাংলায় থাকব, অথচ বাংলা জানব না, এটা চলতে পারে না। শুধু জানে না, তাই নয়, শেখার আগ্রহও নেই। এমনকী বাংলা সম্পর্কে যত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যায়, এঁরা তাই করেন। আর এই স্রোতে আমরা বাঙালিরাও গা ভাসাচ্ছি। আমরাও সাংস্কৃতিক এই আগ্রাসনের মুখে নিজেদের ঠেলে দিচ্ছি।
তাই আমার মনে হয়, স্কুলে বাংলা চালু করার এই নিয়মটা সবার সমর্থন করা উচিত। এখানে সংকীর্ণ রাজনীতি টেনে না আনাই ভাল। হ্যাঁ, পাহাড়েও এই নিয়ম থাকুক। পাহাড় এই রাজ্যেরই একটা অংশ। দার্জিলিং, কালিম্পং এই রাজ্যেরই দুই জেলা। বাংলার সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই পাহাড়ের জন্য। তাহলে তারা বাংলা শিখবে না কেন? বিমল গুরুংরা যতই হইচই করুক, এই নিয়ে পিছিয়ে আসা উচিত হবে না। চতুর্থ ভাষা বা ঐচ্ছিক নয়, তাদেরও বাংলা পড়তে হবে, শিখতে হবে, এটা জোর দিয়ে বলা হোক। সারা বাংলায় যা নিয়ম, পাহাড়ে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হবে কেন? আমার মনে হয়, পাহাড়বাসীর খুব একটা আপত্তি থাকবে না। বিমল গুরুং এটা নিয়ে আন্দোলন করতেই পারেন। কিন্তু এই ইস্যুতে পিছিয়ে গেলে গুরুংরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবেন। রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো হয়ে উঠবেন। তখন পাহাড় আরও অশান্ত হয়ে উঠবে। তাই জোর দিয়ে বলা হোক, পাহাড়ের ছাত্রদেরও রাজ্যের মূলস্রোতেই থাকতে হবে, বাংলা শিখতে হবে।