স্বরূপ গোস্বামী
২০০২। গুজরাটে ভয়বাহ দাঙ্গা। খোদ বিজেপির ভেতরেই জোরালো দাবি উঠল, মোদিকে সরাতে হবে। ছোট খাটো বা মাঝারি মানের নেতারা এমন দাবি তোলেননি। মোদিকে সরানোর দাবি ছিল খোদ অটল বিহারী বাজপেয়ীর। সেদিন মোদির পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি। আজ কী চমৎকার প্রতিদানটাই না পেলেন! মোদি মাঝে মাঝেই বলেন, তিনি গুরুদক্ষিণা দিতে চান। জীবনের পশ্চিম সীমান্তে এসে এমন গুরুদক্ষিণা বোধ হয় বর্ষীয়াণ আদবানির প্রাপ্য ছিল না।
অনেকে বলতেই পারেন, সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, এর জন্য মোদিকে দায়ী করা হচ্ছে কেন? তিনি কি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন? না, বিচারপতিকে এমন কোনও নির্দেশ তিনি দিয়েছেন বলে মনে হয় না। সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। ২৫ বছর আগের একটা ঘটনা নিয়ে সিবিআই এত তৎপর হল কেন? সুপ্রিম কোর্টে এত জোরালো সওয়াল করল কেন?
যে সিবিআই তিন বছরেও সারদা মামলার কুলকিনারা করতে পারছে না। অধিকাংশ সময় শীতঘুমে কাটিয়েছে, তারা বাবরি নিয়ে এত সোচ্চার হতে পারে? তাও বিজেপি সরকারের আমলে? সারদা মামলায় সিবিআই কেন মাঝে মাঝে গুটিয়ে যায়, সেটা একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে কাদের নির্দেশে ওঠা–বসা করতে হয়, সেটা এই দেশে কোনও গোপন বিষয় নয়। সহজ কথা, সরকার যেটা চায়, সিবিআই সেটাই করে। আদবানি, যোশিদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মামলা দিতে হবে, সেই দাবিতে সিবিআই সোচ্চার হবে, এটা সরকারের নির্দেশ ছাড়া হতে পারে? হয়ত সরকার সরাসরি এমন নির্দেশ দেয়নি। দেওয়ার দরকারও পড়ে না। সমঝদারদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। আর এই ব্যাপারে সিবিআইয়ের থেকে সমঝদার আর কে আছে?
দেশে এত বিরোধী দল। অনেকেই অনেকরকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কিন্তু এই বিষয়টা সেভাবে উঠে আসেনি। জোর গলায় একজনই বলেছেন, লালুপ্রসাদ যাদব। তাঁকে নিয়ে যতই হাসাহাসি হোক, যতই ব্যঙ্গবিদ্রুপ হোক, রাজনৈতিক চেতনা ও দূরদর্শিতায় তিনি অনেকের থেকে এগিয়ে, এটা বহুবার প্রমাণিত। এদেশের অনেক তাবড় নেতার থেকে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি। আজ যেটা লালু বলছেন, একদিন বাকিরাও হয়ত সুর মেলাবেন। সিবিআইয়ের কোনও এক কর্তা একদিন নিশ্চয় অবসর নেবেন। সরকারি দাক্ষিণ্য না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হতেই পারেন। শেষ বয়সে বাজার গরম করার জন্যই হোক বা বিবেকের দংশনেই হোক, একটা বই লিখতে পারেন। সেদিন হয়ত এই অধ্যায় বেরিয়ে আসতে পারে।
লালুর কথা বলছিলাম। রাজনৈতিকভাবে ঠিক তেমনই এক বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র লালকৃষ্ণ আদবানি। বাবরির ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু তারপর থেকে মূল্যবোধের রাজনীতিই করে এসেছেন। হাওলায় নাম ওঠায় সঙ্গেসঙ্গে পদত্যাগ করেছিলেন লোকসভা থেকে। বলেছিলেন, যতদিন না আদালতে নিষ্কলঙ্ক প্রমাণিত হচ্ছেন, আর ভোটে দাঁড়াবেন না। সত্যি সত্যিই কথা রেখেছিলেন। প্রধানমন্ত্রিত্বের ব্যাটন ছেড়ে দিয়েছিলেন বাজপেয়ীর হাতে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সৌজন্য হারিয়ে ফেলেননি। তিনিই দলের অন্যতম কাণ্ডারী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে হওয়াটাই স্বাভাবিক। হয়ত অভিমানে দু–এক কথা বলেও ফেলেছেন। কিন্তু সেই অভিমান কি একেবারেই অনায্য? দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে তাঁকে ডাকা হয় না, ডাকলেও বলতে দেওয়া হয় না। কোথায় কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তাঁর মতামত নেওয়া হয় না। মোদি–অমিত শাহরা যেভাবে তাঁকে উপেক্ষা করে চলেছেন, এই উপেক্ষা কি সত্যিই তাঁর প্রাপ্য ছিল? তিনিই সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি, এটা অনেকেই জানতেন। দলের ভেতরেও এমন দাবি বেশ জোরালো। তিনি থাকতে অন্য কাউকে রাষ্ট্রপতি করা একটু কঠিনই হত। আবার তাঁকে রাষ্ট্রপতি মেনে নেওয়াও মুশকিল। নানা সময়ে নানা বাধা আসতে পারে। আর যাই হোক, তাঁকে ‘রাবার স্ট্যাম্প’ রাষ্ট্রপতি বানানো যাবে না। এমন লোক রাইসিনা হিলসে বসলে মাঝে মাঝেই বিড়ম্বনা বাড়বে। সত্যিই তো, এমন লোককে মোদি–অমিত শাহরা চাইবেন কেন?
নিজেরা যেটা পারছিলেন না, সেটা সুপ্রিম কোর্ট করে দিল। তাই এই রায়ে যদি সবথেকে বেশি কেউ আনন্দ পেয়ে থাকেন, সেটা নরেন্দ্র মোদি। বিচক্ষণ আদবানি অঙ্কগুলো বোঝেন না, এমন তো নয়। রাজনৈতিক সৌজন্য ও সংযম দেখিয়ে হয়ত নীরব আছেন। কোনও একদিন এই সংযম শিথিল হতেই পারে। সেদিন তিনিও হয়ত এমন অভিযোগ তুলতে পারেন। শিষ্যর কাছে যে গুরুদক্ষিণা পেলেন, এমনটা সত্যিই তাঁর প্রাপ্য ছিল না।