স্বরূপ গোস্বামী
অসীম দাশগুপ্তকে কখনও সাদা ছাড়া অন্য পোশাকে দেখেছেন ? সেই সাদা জামা, সাদা প্যান্ট। দিল্লি গেলে, বা বিদেশ যেতে হলে বড়জোর কখনও কোট-প্যান্ট পরতে হয়। কিন্তু কলকাতায় থাকলে ওই সাদা পোশাকটাই তাঁর পরিচিতি।
অসীম দাশগুপ্ত যখন বাংলা বলেন, তখন সেই বাংলার মধ্যে ইংরাজি শব্দ শুনেছেন ? একটু মনে করে দেখুন তো। আমরা হামেশাই যেসব ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করি, তিনি বিলেতে পড়াশোনা করেও তার কী চমৎকার বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে নেন।
অসীম দাশগুপ্তকে কখনও কোনও বিতর্কিত শব্দ ব্যবহার করতে শুনেছেন ? প্রায় আড়াই দশক মন্ত্রী ছিলেন। কখনও তাঁর মন্তব্যকে ঘিরে কোনও বিতর্কের কথা মনে পড়ছে ?
আসলে, অসীম দাশগুপ্ত মানুষটাই অন্যরমক। পোশাকটাও সাদা। মানুষটাও সাদা।
রবি ঠাকুরের একটা গান আছে, ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ তোমার মাঝে আমার প্রকাশ তাই তো এত মধুর।’ রবি ঠাকুরের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে তাঁর জন্ম (১৯৪৬)। তবু কেন জানি না, মাঝে মাঝে মনে হয়, এই গানটা বোধ হয় তাঁর জন্যই লেখা হয়েছিল। আটের দশকে, নয়ের দশকে বিধানসভার বাজেটে শাসক ও বিরোধী অনেক বিধায়ককেই এই গানের উপমাটা ব্যবহার করতে শুনেছি। হ্যাঁ, ‘সীমার মাঝেই’ তাঁর বিচরণ, সেখানেই তাঁর ‘আপন সুর’। আর প্রকাশ! বরাবরই মধুর। এমনকি তথ্য আর যুক্তিতে তীব্র বিরোধীতা করলে, সেই বিরোধীতাও বড় মধুর।
বেশি পুরানো কথা থাক, গতকাল বিকেলের কথা। সল্টলেকের স্ট্যাডলে সিটিজেন্স ফোরামের ঐতিহাসিক সূচনা। খুব অল্প কয়েকজন হাজির ছিলেন। এই অধমেরও হাজির থাকার সুযোগ হয়েছিল। সবচেয়ে শানিত আক্রমণ যাঁর কণ্ঠ থেকে এসেছিল, তিনি সাদা পোশাকের সেই মানুষটা। একবারও তৃণমূলের নাম করেননি। একবারও মুখ্যমন্ত্রীর নাম করেননি। একবারও বলেননি সিপিএমকে ভোট দিন। একবারও বলেননি তৃণমূলকে হারান। অথচ, নিজের অনুভূতি কী চমৎকারভাবে মেলে ধরলেন। যাঁরা হাজির ছিলেন, অনেকেই নিজের নিজের জগতের দিকপাল মানুষ, বিদগ্ধ মানুষ। আইনজীবী থেকে চিকিৎসক, আই এ এস থেকে চিত্রপরিচালক, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থেকে প্রাক্তন উপাচার্য, কে ছিলেন না ? কিন্তু এমন সংযম আর কার কথায় ছিল ? অথচ, এত স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ বার্তা আর কার কথায় ছিল ?
কাগজে সেসব বক্তব্য ব্রাত্যই থেকেছে। বেঙ্গলটাইমসে তাঁর বক্তব্যের অনেকটাই গতকাল ছাপা হয়েছিল। বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধে নেমেছে। ছোট্ট একটি চা চক্র। কিছু খেলে চাইছিলেন না। একজন জোর করে এনে বসালেন। একটি স্যান্ডউইচ, আর একটি পান্তুয়া। মনে হচ্ছিল গিয়ে বলি, কেন লড়াই থেকে পিছিয়ে গেলেন ? এই সংকটের পরিস্থিতিতে আপনার মতো বিশ্বাসযোগ্য মুখ আর কে আছেন ? পরে মনে হল, থাক, আর বিড়ম্বনায় ফেলা ঠিক হবে না।
অনেক আগে থেকে তাঁর নাম ভেসে উঠেছিল। কিন্তু তিনদিন আগে শোনা গেল, তিনি নাকি দাঁড়াতে চাইছেন না। দুদিন আগে হাওয়ায় ভেসে উঠল রবীন মণ্ডলের নাম। ভাসিয়ে দিলেন স্বয়ং গৌতম দেব। গতকাল বিকেলেও জানি, মেয়র পদপ্রার্থী হচ্ছেন রবীন মণ্ডল। কেন জানি না, ঠিক মানতে পারছিলাম না। পরিষদীয় রাজনীতির আগ্রহী ছাত্র হিসেবে রবীনবাবুকেও চিনি দুই দশক ধরে। তিনি যে সময় চিফ হুইপ, ঘটনাচক্রে সেই সময় বিধানসভার অধিবেশনে আমার থেকে বেশি হাজিরা বোধ হয় স্বয়ং রবীনবাবুরও ছিল না। সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে ভাল-মন্দ দুটো দিকই তখন কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। চারিদিকে যখন সিন্ডিকেট নিয়ে এত আলোচনা, তখন বামফ্রন্টের মুখ হবেন রবীন মণ্ডল! কোথায় যেন একটা দ্বিধা থেকেই গিয়েছিল।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় অসীমবাবু একজনকে বলে গেলেন, ‘এখন থেকে সকাল, বিকেল, সন্ধে সবসময়ই তো বাইরে থাকতে হবে। তাই ভোটটা পেরিয়ে যাক। তারপর বসা যাবে।’ তখনও কিছু আঁচ করিনি। কারণ, প্রচারে তো তাঁকে ব্যস্ত থাকতেই হবে। তখনও বোধ হয় তিনি নিজেও জানতেন না, ছবিটা কী হতে চলেছে। আসল চমকটা বোধ হয় তোলা ছিল রবিবাসরীয় দুপুরের জন্যই।
এবার সল্টলেকের বিন্যাসটা বড় অদ্ভুত। কর্পোরেশনের ৪১ আসনের মধ্যে সল্টলেকে মাত্র ১৩ টি। একটি মহিশবাথানের পঞ্চায়েত এলাকা। আর ২৭ টি রাজারহাটের এলাকা, যেখানে নিশ্চিতভাবেই দাপিয়ে বেড়াবে বাইকবাহিনী। পুলিশ কী ভূমিকা নিতে পারে, তা জানাই আছে। নির্বাচন কমিশন যে এই নির্বাচনেও চোখ আর কান বন্ধ রাখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে, তা নিয়েও কোনও সংশয় নেই। তাই নির্বাচনে কী ফল হবে, বাইক বাহিনীর দাপট কতটা আটকানো যাবে, বলা মুশকিল।
ড্যাং ড্যাং করে তৃণমূল জিতে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তৃণমূল জিতলে মেয়র কে হবেন ? সব্যসাচী দত্ত ? তাপস চ্যাটার্জি ? কৃষ্ণা চক্রবর্তী ? এঁদের কাউকে অসীমবাবুর একশো মাইলের মধ্যে বসানো যাবে ? যোগ্যতা ও সততার বিচারে অসীমবাবু দশে দশ পেলে এঁদের কাউকে এক নম্বর দেওয়া যাবে ?
হ্যাঁ, তফাত এতটাই।