স্বরূপ গোস্বামী
ধরা যাক, আপনি ইতিহাস পড়ছেন। মুঘল সাম্রাজ্যের কথা জানতে চাইছেন। আপনি দেখলেন, সেখানে বাবরের কথা নেই। হুমায়ুনের কথা নেই। এমনকি মুঘলশ্রেষ্ঠ আকবরের কথাও নেই। হঠাৎ করে এসে গেল সাজাহানের কথা। কেমন লাগবে ?
ধরা যাক, আপনি স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা জানতে চাইছেন। সিপাহী বিদ্রোহ নেই, গান্ধীজি নেই, নেতাজি নেই, চিত্তরঞ্জন দাস নেই, অরবিন্দ ঘোষ নেই। শুধু রয়েছে নেহরুর কথা। কেমন লাগবে ?
ইতিহাসের এমন সিলেবাস যাঁরা তৈরি করবেন, তাঁদের কী মনে হবে ? যে শিক্ষামন্ত্রী এমন সিলেবাসের নির্দেশ দেবেন, তাঁকে কী মনে হবে ?
আজগুবি মনে হচ্ছে ? আমাদের রাজ্যে এমনটাই তো হতে চলেছে। সিঙ্গুর রায়ের পরই শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করে দিলেন, এই আন্দলনের কথা সিলেবাসে থাকবে। সিলেবাস কমিটির কাছে এই মর্মে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে।
যেমন মন্ত্রী, সিলেবাস কমিটিও তেমনই হবে। মন্ত্রীর প্রস্তাব মানে কার্যত তা নির্দেশ। কর্তা ধরে আনতে বললে কর্তাভজারা বেঁধে আনতে তৈরি। অতএব, কাল বিলম্ব না করে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তাঁরাও জানিয়ে দিলেন, সিঙ্গুর আন্দোলন ও মমতা ব্যানার্জির লড়াইকে সিলেবাসে আনা হবে। সিলেবাস কমিটি যদি এই প্রস্তাবকে উপেক্ষা করত, তাহলে বুঝতাম, তাঁরা সত্যিই স্বতন্ত্র। শিক্ষামন্ত্রীর হুকুম তামিল করে তাঁরা বুঝিয়ে দিলেন, তাঁদের টিকি অন্য কোথাও বাঁধা।
সিলেবাস সম্পর্কে ও শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষামন্ত্রীর ধারনা কেমন, তা মাঝে মাঝেই টের পাওয়া যায়। তিনি যে কোনও বিষয়েরই গভীরে পৌঁছতে পারেন না, সারাদিনে তাঁর নানা অবান্তর কথায় তা বেশ বোঝা যায়। ক্লাস নাইন বা ক্লাস টেনের সিলেবাসে কী আছে, সে সম্পর্কে সম্যক ধারনা আছে বলে মনে হয় না। খোঁজ নিয়েছেন বলেও মনে হয় না।
আগে ক্লাস নাইনের সিলেবাসে ছিল প্রাচীন যুগ থেকে সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত। ক্লাস টেনে ছিল সিপাহি বিদ্রোহ থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত (১৮৫৭-১৯৪৭)। এখন কিছুটা বদল হয়েছে। নাইনের সিলেবাসে পুরোটাই ইউরোপের ইতিহাস। আর ক্লাস টেনের সময়কালকেও স্বাধীনতা পর্যন্তই (১৯৪৭) সীমিত রাখা হয়েছে।
মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স থেকে এম এ। প্রায় সবস্তরেই ইতিহাসের সিলেবাস সময়ভিত্তিক। যেমন, ক্লাস টেনের কথাই ধরুন। সেখানে সময়কাল ১৯৪৭ পর্যন্ত। এর মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের কথা যেমন আসছে, তেমনি অরবিন্দ ঘোষ, ক্ষুদিরাম বসু, সূর্য সেন, চিত্তরঞ্জন দাস, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, মৌলানা আজাদরাও আছেন। মহারানীর ঘোষণা পত্র থেকে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, বঙ্গভঙ্গ থেকে ভারত ছাড়ো, স্বরাজ্য দল থেকে আজাদ হিন্দ –এই সময়কালের নানা ঘটনাও উঠে এসেছে।
১৯৪৭ থেকে একলাফে হঠাৎ করে ২০১৬। মাঝে প্রায় সত্তর বছর হাওয়া! বিধান রায় থেকে সিদ্ধার্থ রায়, জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের কথা থাকবে না ? একেবারে লাফ দিয়ে মমতা ব্যানার্জি ?
এমন আজগুবি সিলেবাস ভারতের কোনও রাজ্যে আছে ? সারা পৃথিবীর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। যদি স্বাধীনোত্তর বাংলার কথা পড়াতেই হয়, তাহলে বিধানচন্দ্র রায়ের কথা থাকবে না? তাঁর আমলের শিল্পায়নের কথা থাকবে না ? জরুরি অবস্থা থাকবে না ? অপারেশন বর্গা, ভূমিসংস্কার বা পঞ্চায়েতিরাজের কথা থাকবে না ? একেবারে লাফ দিয়ে সিঙ্গুর ?
সিঙ্গুর নিয়েও সঠিক ইতিহাস থাকবে? কারও লেখার সাহস হবে ? লিখতে গেলে সেই বই অনুমোদন পাবে ? কোনও ছাত্র যদি মনে করে, এই আন্দোলন বাংলার শিল্পায়নের পথে বড় ধাক্কা, তাঁকে নম্বর দেওয়া হবে তো ? অনশনের কথা নিশ্চয় থাকবে, কিন্তু নেত্রীর উপস্থিতিতে, তাঁর প্ররোচনায় বিধানসভা ভাঙচুর, এক মাস ধরে রাস্তা আটকে ধর্না, টাটার বিতাড়ন- এগুলোও থাকবে তো ?
নিশ্চিত থাকতে পারেন, সিলেবাসটা নির্লজ্জভাবেই একপেশে হবে। সরকারের ধামাধরা লোকেরা কমিটিতে থাকলে যেমন সিলেবাস হওয়ার, তেমনই হবে। নিশ্চিত থাকতে পারেন, এই প্রশ্নটা অনিবার্যভাবেই আসবে। অর্থাৎ, এই গুণবন্দনা ছাত্রদের মুখস্থ করতেই হবে। এই প্রশ্নের হয়ত কোনও ‘অথবা’ থাকবে না, উত্তর লিখতে ছাত্ররা বাধ্য থাকবে। কী জানি, হয়ত মৌখিকভাবে এমন ফতোয়াও দেওয়া হবে, এই উত্তর যে লিখবে না, তাকে ‘টাইট’ দিতে হবে।
একেবারে নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সিলেবাসে তাঁর মহিমা-কীর্তন করা হবে। এটা জেনেও মুখ্যমন্ত্রী দিব্যি সায় দিলেন। জীবিত অবস্থায় গান্ধীজি বা নেতাজির নাম সিলেবাসে আসেনি। এমনকি নেহরু দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রী থাকলেও নিজের নাম সিলেবাসে ঢোকানোর কোনও চেষ্টা করেননি। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কথাও আসেনি। ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীই জীবিত অবস্থায় নিজেকে সিলেবাসে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা নেই।
আমাদের শিক্ষামন্ত্রীও বড় অদ্ভুত। নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে নিজে নিজেই ডিগ্রি নিয়ে নিচ্ছেন। রিসার্চ গাইডকে ইউনিভার্সিটির ভিসি বানিয়ে দিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীও নিজের জীবদ্দশায় সিলেবাসে নিজেরই গুণকীর্তন ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। এবার সিলেবাস কমিটির মাথা কবে রাজ্যসভায় যান, দেখার অপেক্ষায় রইলাম।