সত্যজিৎ রায়কেও নকল করতেন!

মৌতান ঘোষাল
আজ কিশোর কুমারের জন্মদিন। ইচ্ছে করেই নামটার আগে কোন বিশেষণ দিলাম না। কারন তাঁর সামনে বা পেছনে অন্য কোনও পরিচয় লাগে না। এই নামটাই তো যথেষ্ট ভারতবাসীর কাছে।
তাঁর সঙ্গীত, অভিনয় তাঁকে কীংবদন্তীর আসনে বসিয়েছে যেমন,তেমনই তাঁর নিজস্বতা, চাল চলন, ভাবনা, কথা বলা তাঁকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। শিল্পী অনেকেই হন, কিন্তু তার পাশাপাশি ‘ ক্যারেক্টর’ হয়ে উঠতে কজন পারেন! এখানে তাই মানুষ কিশোর কুমারকে নিয়ে কথা বলবো। যার পরিচয় পাওয়া যায় তার জীবনের নানা গল্প থেকে। যে গল্পগুলি উঠে আসে তাঁর বিভিন্ন সময়ের সহকর্মীদের স্মৃতিচারণে।

kishore34

কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক সত্যজিত রায়ের “ঘরে বাইরে” ছবিতে কিশোর কুমারের গলায় সেই বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত “বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান” গানের কথা তো সবার মনে গাঁথা। কিন্তু এই গান রেকর্ডিং-এর সময় এক অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়েছিলেন কিশোর কুমার। প্রয়াত এডিটর দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনিষ্ট আড্ডায় অনেকবার বলেছেন সেই মজার আখ্যান। তাঁর নিজের ছবির সব বিভাগের কাজেই নিজের বিশেষত্বের ছাপ রাখতেন মাণিক বাবু। অবশ্যই সঙ্গীতেও। কাজেই এই গানটিও তার ব্যাতিক্রম নয়। রেকর্ডিং-এর আগে তিনি কিশোর কুমারকে বলেন যে, গানটি খালি গলায় থাকবে দৃশ্যে। তিনি যে ভাবে গাইছেন ঠিক সেই ভাবেই যেন গান কিশোর। বলে পুরো গানটাই গাইলেন সত্যজিতবাবু। আর রেকর্ডিং-এ ঢুকে হুবহু তাঁর গলায় গান গাইতে শুরু করেন। কিশোর কুমারের একাধিক প্রতিভার মধ্যে মিমিক্রির ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। গান শুরু হওয়ার পরই পরিচালক তাঁকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন “এটা কী করছ?” কিশোর কুমার বলেন ‘এই যে আপনি বললেন একদম আপনার মত করে গাইতে।’ পরে অবশ্য ঠিকঠাক গেয়েছিলেন। আর তারপর কেমন হয় সে গান তা তো সবার জানা। সত্যজিৎ রায় তার আগেও ব্যবহার করেছিলেন কিশোরকে। চারুলতা ছবিতে ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী’ গানে। এটিও ছিল খালি গলার গান। খালি গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত! অনেকেই মানতে পারেননি ব্যাপারটি। কিন্তু সত্যজিৎ রায় সেই সাহস দেখিয়েছিলেন। এবং, এই গানগুলির জন্য কিশোর কুমার কোনও পারিশ্রমিক নেননি।
kishore9

কিশোর কুমারের এক অদ্ভুত স্বভাব ছিল। তিনি নাকি গীতিকারদের থেকে পেন নিতেন। আর ফেরত দিতেন না। খুব সচেতন ভাবেই। এই নিয়ে নাকি গুলজারের সঙ্গে বেশ মনমালিন্য হয়েছিল একবার। অনেকে অবশ্য তাঁর এই স্বভাবকে খুব ভালভাবেই নিতেন। যেমন গীতিকার শিবাস বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তার বিখ্যাত গান “তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণ যাত্রা” গানটি গেয়ে তার এতোটাই তৃপ্তি হয়েছিল যে তিনি গানটির পারিশ্রমিক প্রাপ্য টাকা তিনি প্রোযোজককে ফেরত দেন। আরও একটি গানের ক্ষেত্রে তিনি টাকা ফেরত দিয়ে দেন। সেটি হল অমর কন্টক ছবির ‘চিতাতেই সব শেষ’। এই গানটি রেকর্ড করতে গিয়েও কেঁদে ফেলেছিলেন কিশোর। বলেছিলেন, জীবনের গান তো অনেক গেয়েছি। কিন্তু এ মৃত্যুর গান। এই গান গেয়ে টাকা নিতে পারব না।’ এই ঘটনা সবার জানা, কিন্তু যেটা জানা নেই তা হল গীতিকার শিব্দাস বন্দ্যোপাধ্যের কলমটিও তিনি তাকে ফেরত দিয়ে দেন। এমনই ছিলেন কিশোর কুমার, সবার থেকে আলাদা।
“ডন” ছবির গানের রেকর্ডিং-এও ঘটান এক অদ্ভুত কান্ড। প্রথম দিন স্টুডিওতে এসেও গান রেকর্ড না করেই চলে যান, স্রেফ ভাল লাগছে না বলে। পর দিন আবার রেকর্ডিংয়ে যখন টেনশনে পায়চারি করছেন সুরকার লক্ষ্মীকান্ত ও পেয়ারেলাল, তখন স্টুডিওতে ঢুকলেন কিশোর, গালটা ফোলা। ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন সবাই তৈরি কিনা। তারপর স্টুডিওয় ঢুকে মুখ ভর্তি আনের পিক ফেলে শুরু করলেন খাইকে পান বানারস ওয়ালা”। বলেছিলেন, পান না খেলে এই গানের আমেজ আসবে না।
এক প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শোনা ১৯৮৭সালে যেদিন তিনি মারা গেলেন, সেদিন খবরটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া মাত্র বেনারসের ৯০%পানের দোকানদার দোকান বন্ধ করে দিয়েছিলেন মুহুর্তের মধ্যে।

kishore13

আসলে তার স্থান বরাবরই মানুষের হৃদয়। শুধু প্রতিভা দিয়ে এত কাছে কি যাওয়া যায়! “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল”এও, তিনি মরমে রয়ে গেছেন তাঁর এই বৈচিত্রময় জীবনের জন্যই। আই তিনি আক্ষরিক অর্থেই কিংবদন্তি।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.