মুখোমুখি দুই কিংবদন্তি। কিশোর কুমারের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন লতা মঙ্গেশকার! না, কাল্পনিক ঘটনা নয়। সত্যিই এমনটা হয়েছিল। কিশোর কুমারের জন্মদিনে সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ তুলে আনলেন স্বরূপ গোস্বামী ।।
ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছিল । ফিল্মি দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কই চুকিয়ে দিতে চাইছিলেন। মিডিয়া থেকেও দূরে দূরেই থাকতেন। ঠিক করেই নিয়েছিলেন , বম্বে ছেড়ে চলে যাবেন গ্রামের বাড়ি খান্ডোয়ায়। যেই বাড়িতে যাচ্ছে, ফিরিয়ে দিচ্ছেন, নয়তো লুকিয়ে যাচ্ছেন। সাক্ষাৎকার ! পালিয়ে বেড়াচ্ছেন । শর্ত দিলেন, ‘একমাত্র লতা মঙ্গেশকার যদি সাক্ষাৎকার নেয় , তবেই সাক্ষাৎকার দিতে পারি।’ লতাকে বলা হল এই কঠিন কাজটির দায়িত্ব নিতে । লতা এলেন । একথা – সেকথায় সময় গড়িয়ে গেল। কোথাও খুনসুটি ।আবার কোথাও বেরিয়ে এল চাপা এক যন্ত্রনা। সব মিলিয়ে সেই আড্ডার টুকরো কিছু মুহূর্ত উপভোগ করুন।
লতাঃ কিশোরদা , আপনি কখনও অভিনেতা, কখনও পরিচালক । কখনও সুর দিচ্ছেন। কখনও লিখছেন । আবার কখনও গাইছেন। এত কাজের মাঝে কোনটা করে বেশি তৃপ্তি পান?
কিশোরঃ আমি যখন একেবারে ছোট , তখন থেকেই আমার প্রিয় হল গান। শুরু থেকেই একজনকে গুরু বলে মেনেছি । এখনও তাঁকেই গুরু বলে মনে করি। তিনি কুন্দনলাল সায়গাল।
লতাঃ উনি আমারও গুরু।
কিশোরঃ তাহলে তুমি বুঝবে। সঙ্গীতই আমার জীবনে প্রথম প্রেম। আর অ্যাক্টিং তো অনেক পরে এসেছে । ওটা আমি করতেও চাইনি । আমার বড় দাদা অশোক কুমারের পাল্লায় পড়ে করতে হয়েছিল। দাদা বলল, তুই অ্যাক্টিং কর। আমি বললাম, আমাকে দিয়ে ওসব করিও না। অ্যাক্টিং মানেই কেমন যেন বানানো । আর সঙ্গীত বেরিয়ে আসে মানুষের হৃদয় থেকে । হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসা গানই মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাতে পারে। বরাবর এটাই মনে করে এসেছি। আর তাই গানই আমার প্রিয়।
লতাঃ আপনাকে নিয়ে লোকের অনেক দুশ্চিন্তা । আপনি কথা দিয়েও নাকি অনুষ্ঠানে যান না! এরকম একটা প্রচার আছে।
কিশোরঃ কেন যে লোকে এসব কথা ছড়ায় , বুঝিনা । যারা আমাকে ভালোবাসে, তারাও বলে । যারা সহ্য করতে পারে না , তারা তো বলেই। অথচ, আমি জানি , লোকে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তাদের আমি হতাশ করতে পারি না। আমি কথা দিলে অনুষ্ঠানে যাই, আগামী দিনেও যাব । কিন্তু এই রটনাকে কে থামাবে?
লতাঃ কিন্তু এত লোক থাকতে আপনাকে নিয়েই এসব রটনা কেন?
কিশোরঃ দুনিয়া ক্যাহেতা মুঝকো পাগল। ম্যায় ক্যাহতা দুনিয়া কো পাগল। আসলে আমাকে পাগল ভেবে বা পাগল প্রচার করে কেউ কেউ বেশি আনন্দ পায়। আরে বাবা, আমাকে যতখানি পাগল ভাবে, আমি ততখানি পাগল কিন্তু নই । তবু লোকে যখন পাগল ভাবে, মজাই পাই। তখন মনে হয়, এ যখন পাগল ভেবেই নিয়েছে, তখন আরও বেশি করে পাগলামি করি।
লতাঃ এতদিন ধরে গাইছেন। এত সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন । কার সঙ্গে কাজ করে সবথেকে ভাল লেগেছে ?
কিশোরঃ একেবারে শুরুর দিককার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। প্রথমেই করতে হবে খেমচাঁদ প্রকাশের নাম । তোমার আর আমার পরিচয় তো ওখানেই । তোমার মনে আছে? তুমি ট্রেনে উঠলে , আমিও উঠলাম । তুমি আমার দিকে তাকালে, আমিও তাকালাম। তুমি নামলে, আমিও নামলাম । তুমি টাঙ্গায় , আমিও উঠলাম। তুমি বম্বে টকিজের গেটে গেলে, আমিও গেলাম। তুমি ভাবছিলে, এ আবার কে পিছু নিচ্ছে। তারপর আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। তুমি গাইছিলে মহল ছবিতে, আর আমি জিদ্দিতে। সেই ওঁর সঙ্গে কাজ করা শুরু। আমার দাদামনি অশোক কুমার বরং আমাকে নিরুৎসাহিত করতেন। বলতেন , তোর গলায় মডিউলেশন ঠিক হচ্ছে না। উনি কেমন গাইতেন, তুমি তো জানো ( বলেই অশোক কুমারের গলা নকল করে গেয়ে ফেললেন। উল্টোদিকে লতা তখন হেসে চলেছেন।) কিন্তু বড় দাদা , কী বলি বলো তো! ঠিক আছে, বলছে বলুক । কিন্তু আমাকে যা উৎসাহ দেওয়ার খেমচাঁদজি দিয়েছিলেন। উনি তখন দাদামনিকে বললেন, দেখো অশোক , এই ছেলেকে আমার কাছে ছেড়ে দাও।আমি একে তৈরি করে নেব। এভাবেই উনি গান গাইয়েছেন। আমার এগিয়ে আসার পেছনে তাঁর বিরাট ভূমিকা। তারপর এস ডি বর্মণ সাব। উনি একেবারেই আলাদা মানুষ। যেখানেই গাইতে সমস্যা হচ্ছে , বুঝতে পারতেন। বলতেন, গাইতে অসুবিধা হচ্ছে ? বদলে দেব ? আমি করুণভাবে তাকিয়ে বলতাম , বদলে দিলে ভাল হয়। উনি তখন সুর বদলে দিতেন।
লতাঃ সব সময় পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান কেন?
কিশোরঃ কেন জানি না । ঠিক মনিয়ে উঠতে পারি না। তাই ইচ্ছে মতো পালিয়ে বেড়াই। গানের নামে যা সব চলছে, মেনে নিতেও পারি না। আগের মতো সেই গান কোথায়? তুমি বলো, আগে গান গাওয়ার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল না ! তুমি তো আরও ভাল জানবে। তুমি আমার আগে থেকে গাইছো। আমি তো তোমার কাছে কিছুই নই। আমি এই বুড়ো বয়সেও হারমোনিয়াম জানি না। সা রে গা মা মা পা ধা নি কিছুই জানি না । কিন্তু পাবলিক এসব বিশ্বাস করতেই চায় না। আচ্ছা লতা, তুমি তো জানো, আমি এসব কিছুই জানি না । তুমি ওই লোকগুলোকে একটু বুঝিও প্লিজ।
লতাঃ কিশোরদা , আমার সঙ্গে অনুষ্ঠান করতে আপনার কেমন লাগে? সত্যি বলবেন কিন্তু।
কিশোরঃ কী বলি বলো তো! আমার তো দারুন লাগে। তবে মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় । তুমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শান্ত হয়ে গান গাও । আর আমি মঞ্চে লাফালাফি করি। মাঝে মাঝে আড়চোখে তোমাকে দেখি, তুমি আবার রেগে যাচ্ছো না তো!
লতাঃ আমার একটুও খারাপ লাগে না । বরং, আমার নিজের মধ্যে একটা সমস্যা আছে । আমি এদিক ওদিক যেতে যেতে গান করতে পারি না।
কিশোরঃ না ,না। আমার মতো তুমি কেন করতে যাবে ? তুমি যা করো , একেবারে ঠিক করো। আসলে, আমি আগে আক্টিং করতাম তো। লাফালাফিটা একরকম অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে । দর্শকরাও বোধ হয় আমার কাছে তেমনটাই চায়। তাই গান করি, সঙ্গে একটু লাফালাফিও করি। দর্শকদের ডাবল আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি।
লতাঃ শোনা যাচ্ছে, আপনি নাকি বম্বের পাট চুকিয়ে গ্রামের ফিরতে চাইছেন । আর নাকি প্লে ব্যাক করবেন না । হঠাৎ কী এমন হল যে পালিয়ে যেতে চাইছেন?
কিশোরঃ দেখো লতা , আমি জীবনের অনেক চড়াই উতরাই দেখেছি । আজ নিজের চেষ্টায় , অনেকের সাহায্যে একটা জায়গায় এসেছি । অভিনয় করে , গান করে অনেক মানুষকে আনন্দ দিয়েছি। নিজেও অনেককিছু পেয়েছি। আর কিই বা চাওয়ার থাকতে পারে! খারাপ সময় আসার আগে নিজে থেকে সরে যাওয়াই ভাল। জীবনের এমন সময় ডেকে আনতে চাই না, যেখানে লোকে করুণা করবে । তাছাড়া , যত বয়স বাড়ছে, তত বেশি করে এই শহর থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে । ততই নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।
লতাঃ আপনি নিজেই বললেন , সঙ্গীত আপনার প্রথম প্রেম। আপনার যন্ত্রনা বুঝি। আপনি সিনেমা ছাড়তে পারেন । প্লেব্যাক ছাড়তে পারেন । কিন্তু গান ছাড়তে পারবেন? কষ্ট হবে না?
কিশোরঃ গান কি ছাড়তে পারি! ছাড়ব কেন ? টাকা পয়সার দরকার নেই । গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দেব। তুমিও তো চ্যারিটি করো । আমিও করব । ডাকলেই হাজির হয়ে যাব।
লতাঃ কিশোর দা , আমরা দুজন একসঙ্গে যদি এই কাজটা করি!
কিশোরঃ খুব ভাল হয় । একসঙ্গে ভাল কাজ করার আনন্দই আলাদা। তুমি যখন ডাকবে, আমাকে পাবে। যত দিন বেঁচে আছি, তোমার একডাকেই হাজির হয়ে যাব।