ভ্রমণঃ লেপচা জগৎ

ভ্রমণঃ লেপচা জগৎ

পাগলি তোমার সঙ্গে

 

পাইন বনে মেঘের আনাগোনা। সেখান থেকে মুগ্ধতার চিঠি। লিখলেন স্বরূপ গোস্বামী।।

 

অনেকদিন তোমাকে চিঠি লেখা হয়নি। বলাই যায়, ব্যস্ত ছিলাম। ব্যস্ত দুনিয়ায় ব্যস্ততা এমন একটা অজুহাত, সহজেই লোকে বিশ্বাস করে নেয়। কারণ, আমি ছাড়া প্রায় সবাই ব্যস্ত। তাদের ভিড়ে নিজেকে মিশিয়ে ফেলাই যায়। কিন্তু আমি নিজে তো জানি, আমি মোটেই তেমন ব্যস্ত নই। আমার হাতে অঢেল সময়। তাহলে, এমন ডাঁহা মিথ্যেটা লিখি কী করে!

 

কলকাতায় বসে থাকলে তবু না হয় দু চারটে মিথ্যে লেখা যায়। কিন্তু পাহাড় মানুষকে উদার হতে শেখায়। প্রকৃতির এমন সান্নিধ্যে এসে মিথ্যে বলা উচিত নয়। জানলার ওপারে চোখ রাখলেই ঝলমল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। না, কোনও ‘সাজানো ঘটনা’ বা ‘সাজানো ছবি’ নয়। ঘণ্টা দুই আগেও চারটে চুড়া দেখা যাচ্ছিল। এখন কিছুটা মেঘ এসে দুটো চূড়ো ঢেকে দিয়ে গেছে। তবে দুটো চূড়ো বেশ ভালই দেখাচ্ছে। সকালে ছিল দুধ সাদা রঙ। বেলা বাড়ার পর কেমন যেন নীলাভ চেহারা নিচ্ছে।

lepchajagat2

মেঘের কথা লিখছিলাম। জানো, জানালার ওপারে কী সুন্দর মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। খোলা জানালা দিয়ে ঘরেও ঢুকে পড়েছে। শক্তি চাটুজ্জের কবিতা ধার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে।’ তোমার তো আবার আবার কবিতায় অ্যালার্জি। বেশ, তাহলে গানের ভাষাতেই বলি। মান্না দে-র একটা গান এই সময় খুব মনে পড়ে যাচ্ছে – ‘আমার ইচ্ছে করে শূন্যে উঠে মেঘের উপর দিয়ে হাঁটি।’ আগে যখন গানটা শুনতাম, মনে হত গাঁজাখুরি। খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। ‘মেঘের উপর দিয়ে হাঁটি’! কিন্তু এখন সত্যি সত্যি আমারও হেঁটে বেড়াতে ইচ্ছে করছে। মেঘের কি আর ঠিকানা আছে! কোথায় উড়ে যাবে, কে জানে! তোমার ঠিকানাও তো জানি না। তবু চিঠি লিখতে বাধা কোথায়! যেমনভাবে লিখি, পৌঁছয় না, তবু লিখি।

 

তুমি নিশ্চয় ভাবছ, সাত সকালে আমি কী সব ভুলভাল বকছি। কলকাতায় বসে কাঞ্চনজঙ্ঘাই কোথায়, আর মেঘের উপর হেঁটে বেড়ানোই বা কোথায়! আসলে আমি এখন কলকাতা থেকে অনেক দূরে। জঙ্গলে ঘেরা এক পাহাড়ের দেশে। না, আর হেঁয়ালি করে লাভ নেই। কোথায় আছি, বলেই ফেলি। আমি এখন লেপচা জগতে। এবার নিশ্চয় ভাবছো, লেপচা জগৎ ! সেটা আবার কোথায় ? যদি এই প্রশ্নটা তোমার মনে এসেও থাকে, তাও তোমাকে দোষারোপ করা যাবে না। কারণ, অনেকেই জানে না, এই লেপচা জগতের হদিশ। সমতলের কথা ছেড়ে দিলাম। এই পাহাড়েই বা কজন জানে! এমনকি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে বা শিলিগুড়ি জংশনে যারা সারি সারি গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ট্যুরিস্টদের নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাদেরও অধিকাংশই জানে না। তারা সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে, দার্জিলিং, দার্জিলিং, গ্যাংটক-গ্যাংটক।

 

আরে বাবা, এই দুটো জায়গা তো সবাই জানে। বাঙালিকেও বলিহারি। পিলপিল করে সব ছুটছে দার্জিলিং আর গ্যাংটকে। পারলে সেখানে সুরুচি সঙ্ঘ বা একডালিয়ার দুর্গাপুজো লাগিয়ে দেয়। ভিড় থেকে একুট নির্জনে কটা দিন কাটানোর জন্যই তো বেড়াতে আসা। সেখানে ওই গিজগিজ করা ভিড়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় ! বহুকাল আগে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, গ্যাংটকে গন্ডগোল। আর বাঙালির এই গ্যাংটক আদিখ্যেতা দেখে এখন বেঁচে থাকলে নিশ্চিতভাবেই লিখতেন, ‘গ্যাংটকে গন্ডমুর্খ।’ তিনি নেই তো কী হয়েছে, কোনদিন আমিই লিখে ফেলব।  সিকিম শুনলেই লোকে বলে গ্যাংটক গিয়েছিলে ? যেন সিকিমে আর কোনও জায়গা নেই। ফিরে আসার পথে ট্রেনে যখন সেই ফোনালাপ শুনি, তখনও মাথা গরম হয়ে যায়। ‘জানো তো, আমরা ছাঙ্গু গিয়েছিলাম। বরফ ছিল। অনেক ছবি তুলেছি। দেখবে, ফেসবুকে দেওয়া আছে।’ কে দেখতে চেয়েছে ? এইসব বোকা বোকা ছবিতে ততোধিক বোকা বোকা সব কমেন্টস পড়বে। নাইস পিকস, এটা কোথায়, কবে গেলি ? এসব ন্যাকা ন্যাকা প্রশ্ন। কী আর করা যাবে! এই জাতীয় পাবলিকেরাই সংখ্যায় ভারি। এদের নিয়ে যেতেই যত হুড়োহুড়ি। এরা দার্জিলিং যায়। কিন্তু ফাইভ পয়েন্ট, সেভেন পয়েন্ট নামক চক্করেই পড়ে যায়। পায়ে হেঁটে আসল দার্জিলিংটাকে চেনার চেষ্টাই করল না। হাতে গোনা কয়েকজন পর্যটককে পাবে, যারা দার্জিলিংয়ের স্পন্দনটা অনুভব করতে পেরেছে। তাই যারা প্রকৃতি ভালবাসে না, যারা শপিং মল খোঁজে,  হোটেলের টিভিতে স্টার জলসা বা জি বাংলা না এলে যাদের মুখ ব্যাজার হয়ে যায়, এমনকি ইস্টিকুটুম বা জলনুপুর না দেখলে পেট গুড়গুড় করে, এই লেপচা জগৎ তাদের জন্য নয়।

lepchajagat3

অঞ্জন দত্তর একটা গান মনে পড়ছে ? ‘টুং সোনাদা ঘুম পেরিয়ে, আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে, যখন তখন পৌঁছে যাওয়া যায়।’ গড়পড়তা বাঙালি এই একটা রাস্তার বাইরে আর অন্য রাস্তা খুঁজেও পেল না। কিন্তু দার্জিলিং যাওয়ার আরও একটা চমৎকার রাস্তা আছে, পর্যটকরা সেভাবে জানেই না।  এই রাস্তাটা অবশ্য কার্শিয়াং হয়ে নয়। তুমি নিশ্চয় মিরিক লেকের নাম শুনেছ। মিরিক লেক পেরিয়ে নেপাল বর্ডারে নেমে পড়তে পারো। গাড়ি দাঁড় করিয়ে দশ পনেরো মিনিটের জন্য ঢুকে যাও ভিনদেশে। পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই লাগবে না। বিদেশের মাটিতে এক কাপ চা—মন্দ কী ? সেই ‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই’। সঙ্গে একটু ওয়াই ওয়াই হয়ে যেতে পারে। ওয়াই ওয়াই ? সেটা আবার কী ? ভয় নেই, এটা ম্যাগির পার্বত্য সংস্করণ (অবশ্য এখন তো আবার ম্যাগি নামেও আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে)। এখন কলকাতাতেও পাওয়া যায়। ছোট্ট বিজ্ঞাপন বিরতির মতোই, ছোট্ট বিদেশ বিরতির পর আবার ঢুকে পড়তে পারো ভারতের ভূখণ্ডে। আরও কিছুদূর গেলেই সুখিয়া পোখরি। এলাকাটা বেশ সমৃদ্ধ। বড় বাজার, দোকান, হোটেল, গাড়ি, সবই আছে। সুখিয়া পোখরি পেরিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে ঘুম স্টেশনের দিকে। জিকে-র বইয়ে ঘুম স্টেশনের কথা নিশ্চয় পড়েছো। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু রেল স্টেশন। সেখান থেকে দার্জিলিং মাত্র আট কিলোমিটার। আমাদের এই লেপচা জগৎ অবশ্য ঘুমেরও আট কিলোমিটার আগে। বলতে পারো, সুখিয়া পোখরি আর ঘুমের ঠিক মাঝখানে। জায়গাটা দার্জিলিং থেকে অনেক উঁচুতে। ফলে, ঠান্ডাও বেশি, গাছপালা তো অনেক বেশি। নিঝুম পাইন বন, মাঝে মাঝে ওকের সারি, আর রডোডেনড্রন তো আছেই। পাহাড়ের ওপর কেমন একটা জঙ্গলের আবহ। বাংলার মধ্যে এমন একটা সুন্দর জায়গা আছে, আমরা জানতামই না! কাকে আর দোষারোপ করব!

 

কে যে এই লেপচাজগৎ নাম রেখেছিল, বলা মুশকিল। স্থানীয় লোকেরাও জানে না। তোমার সবজান্তা গুগল বা অন্য সার্চ ইঞ্জিনও সেভাবে জানে না। তবে ব্রিটিশরা জানত। ব্রিটিশরা আসারও অনেক আগে থেকেই এখানে নাকি লেপচারা থাকত। তখন তো এমন সুন্দর রাস্তা ছিল না। যানবাহনও ছিল না। কীভাবে তারা উঠত, কীভাবে জীবনধারনের উপাদান সংগ্রহ করত, সেও এক বিস্ময়। একটু নেমে গেলেই ইংরেজ আমলের একটা বাড়ি আছে। সেটাকেই গেস্ট হাউস বানিয়েছে আমাদের ফরেস্ট ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন। খুব যে ভাড়া, তাও নয়। ফোর বেডেড ডরমেটারিও আছে। খাওয়া নিয়ে টেনশন নেই। ক্যান্টিনে একটু আগে থাকতে বলে রাখলেই হল। একটু উপরে উঠলে, রাস্তার উপর দু একটা ছোটখাটো দোকানও পাওয়া যাবে, সেখানেও খাওয়া যায়। সেই দোকানে একটু আগে থেকে বলে রাখলে ভাল হয়। মোমো, থুকপা, চাউমিন থেকে ওয়াই ওয়াই, সবই পাওয়া যায়। তোমার অবশ্য ডাল ভাতের ব্যামো নেই। দু একদিনের তো ব্যাপার। একটু না হয় পাহাড়ি খাবার খেলে। অবশ্য ডাল, ভাত, মাছও চাইলেই পাওয়া যায়। একটু আগে থেকে বলতে হবে, এই যা।

সমতলের গাড়িওয়ালারা চিনুক আর না চিনুক, ব্যতিক্রমী পর্যটকরা ঠিক জানে। ভাগ্যিস, ট্যুরিজমের অফিস থেকে বুকিং করে এসেছিলাম। নইলে, এখানে এসে তো জায়গাই পেতাম না। এমন নির্জন পাহাড়ে এমন সুন্দর একটা আস্তানা আছে, তা তো জানতামই না। আর এসব জায়গার প্রচারও হয় না (মাঝে মাঝে মনে হয়, বেশি প্রচার না হওয়াই ভাল। যত উটকো লোকের ভিড় বাড়বে)।  দিন দিন ট্যুরিস্ট তো আরও বাড়বে। তখন কী হবে ? রাস্তার ধারে একটা হোম ট্যুরিজম চালু হয়েছে। সেটাও মন্দ নয়। কী ভাবছ, এমন সুন্দর জায়গাটার কথা আগে বলিনি কেন ? নিজেই তো জানতাম না। দু একজনের মুখে শুনেছিলাম ঠিকই, এমন অনেক জায়গার কথাই তো শুনি। আর নেটের ছবি দেখে সব জায়গাই সুন্দর মনে হয়। এভাবে কতবার যে ঠকেছি! ছবি দেখে চলে গেছি। গিয়ে বুঝেছি, ছবির সঙ্গে বাস্তবের অনেক ফারাক। তাই এখানে আসার আগেও একটা ‘কিন্তু কিন্তু’ ব্যাপার ছিল। কিন্তু যেই সুখিয়া পোখরি পেরোলাম, যেই গাড়ির জানালা দিয়ে মেঘ ঢুকে আসছে, তখনই মনে হল, ঠিক জায়গাতেই এসেছি।

lepchajagat4

আমার বাকি সঙ্গীদের উপর খুব রাগ হচ্ছে। বেলা সাড়ে আটটা বাজে। এখনও ব্যাটারা ঘুমোচ্ছে। আরে বাবা, বাড়িতে যত খুশি ঘুমো, কেউ তো বারণ করেনি। বেড়াতে এসে কেউ এভাবে ঘুমোয়! সব ব্যাটা বেরসিক। বাড়িতে তো আমারও ওঠার কোনও ঠিক থাকে না। তাই বলে বাইরে এসে যদি ভোর না দেখলাম, তাহলে তো অর্ধেক আকর্ষণ সেখানেই ফুরিয়ে গেল।

 

আমি ভোর পাঁচটায় উঠে পড়েছিলাম। জানি, ডাকলেও কেউ উঠবে না। সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটানো উচিত নয়। অতএব, একলা চলো রে। ওই তো দূরে, মানেভঞ্জন। টোংলু হয়ে খাড়া রাস্তাটা উঠে গেছে সান্দাকফুর দিকে। বরফে ঢাকা বাংলার সবথেকে উঁচু ভূখণ্ড। ওখানে অনেকে নাকি ট্রেক করে যায়। মধ্যপ্রদেশ যে হারে স্ফীত হচ্ছে, এখন সেই ট্রেক করার কথা ভাবাও যেন দুঃসাহস। ভোরের আলো ফুটছে, একটু একটু করে জেগে উঠছে পাহাড়ি গ্রামগুলো। পাহাড়ে এলে আমার বড্ড দিক গুলিয়ে যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘাটা কোনদিকে পড়বে, বুঝতে পারছিলাম না। কাউকে জিজ্ঞেস করব, তারও উপায় নেই। এত ভোরে রাস্তা শুনশান। একজনকে পেলাম। সে বলল, এদিকে জঙ্গলে ঢাকা পড়ে যাবে। ওই রাস্তার মোড় থেকে দেখতে পাবেন। সে কী অপরূপ দৃশ্য, তোমাকে লিখে বোঝাতে পারব না। মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। ক্যামেরার সাধ্য কী, ওই মুহূর্তকে ধরে রাখে!

 

আমার কুম্ভকর্ণ সঙ্গীদের কথা ভাবছিলাম। ব্যাটাদের উপর তখন আর রাগ নয়, করুণাই হচ্ছিল। ওরা জানল না, ওরা কী হারাল। আচ্ছা, তোমারও তো আগে দেরীতে ওঠা অভ্যেস ছিল। এখনও বুঝি তাই আছে! তুমি এলে কী করতে ? তুমিও কি ওদের মতোই মটকা মেরে বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে ? নাকি ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়তে ? না উঠলে কানের সামনে চিৎকার করতাম। বা, ‘ক্ষমা করো রবি ঠাকুর’ বলে, চিৎকার করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে শুরু করে দিতাম।

আচ্ছা, বেসুরো গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে কারুর ঘুম ভাঙানোটা কি শ্লীলতাহানির পর্যায়ে পড়ে ? পড়লে পড়ুক। ভোর হওয়ার মুখে তোমার হাত ধরে বেরিয়ে পড়ব। ওই পাইন বনে হারিয়ে যাব।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.