স্বরূপ গোস্বামী
যে কোনও নাটকের শুরুতেই ঘোষণা করা হয়, ‘আপনারা আপনাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনগুলি বন্ধ অথবা নিষ্ক্রিয় করে রাখুন।’ আবেদন জানানোই সার। নাটক চলাকালীন মাঝে মাঝেই মোবাইল বেজে ওঠে। এই রোগটা আগেও ছিল। এখন নতুন এক উৎপাত শুরু হয়েছে। ফোন হয়ত সাইলেন্ট। কিন্তু পাশে বসা লোকটি ক্রমাগত ফেসবুক আর বোয়াটসঅ্যাপ করে চলেছে। এরা কেন যে নাটক দেখতে আসে!
বছর দেড়েক আগেকার কথা। রবীন্দ্র সদনে একটি নাটক দেখেছিলাম। পরেশ রাওয়ালের ‘কিষেন ভার্সেস কানহাইয়া’। এককথায় অসাধারণ বললে কম বলা হয়। তবে সবথেকে মজার লেগেছিল শুরুর একটি ঘোষণা। পরেশ রাওয়ালের অভিনব কণ্ঠস্বরে ঘোষণা হল, ‘কিসিকি সকলপে ইয়ে নেহি লিখ্খা র্যহতা হ্যায় কি কোন বেওকুফ, ইডিয়ট আউর গাধে হ্যায়। ইয়ে তব পতা চলতা হ্যা যব হল মে কিসিকো মোবাইল বাজতা হ্যা। আপ গাধে হ্যায়, ইয়ে সাবিত করনা কই জরুরি নেহি। ইসলিয়ে আপনা ফোন বনধ রাখিয়ে।’ অর্থাৎ, কে বোকা ও গাধা, তা তার চেহারায় লেখা থাকে না। এটা তখন বোঝা যায়, যখন কারও মোবাইল বেজে ওঠে। আপনি যে একটি গাধা, সেটা প্রমাণ করা কি খুব জরুরি? তাই দয়া করে আপনার মোবাইল বন্ধ রাখুন।
ভারী চমৎকার একটি ঘোষণা। নাটকটা যত না মনে দাগ কেটেছে, ঘোষণাটা তার থেকেও বেশি দাগ কেটেছে। সেই ঘোষণা মাত্রই সবাই পকেট থেকে ফোন বের করে টপাটপ সুইচ অফ করতে শুরু করলেন। বাংলা নাটক যেদিকে যাচ্ছে, এবার সেখানেও এই ঘোষণা করার সময় এসে গেছে। ‘বিনীত আবেদন’য়ে আর কোনও কাজ হচ্ছে না। কোনও কোনও বয়স্ক মানুষ হয়ত বন্ধ করতে পারেন না বা সাইলেন্ট করতে পারেন না। কিন্তু যাঁরা স্মার্ট ফোন নিয়ে হলে ঢুকেছেন, তাঁরা বন্ধ করতে পারেন না, এটা মানতে রাজি নই। তাহলে সারাক্ষণ হোয়াটসঅ্যাপ করেন কী করে? আসলে, এঁরা নাটকের দর্শকই নন। এর তার সঙ্গে ঢুকে পড়েন। বুদ্ধদেব গুহ লিখেছিলেন, সবাইকে জঙ্গলে পাঠানো উচিত নয়। জঙ্গলে পাঠানোর আগে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হোক। যারা জঙ্গলে আসার যোগ্য, তাদেরই পাঠানো হোক। নাটকের ক্ষেত্রেও মনে হয়, যাঁরা আসেন, তাঁদের অনেকের নাটক দেখার যোগ্যতাই নেই। কেউ সারাক্ষণ ফিসফিস করে যান। কেউ ব্যস্ত মোবাইল হাতে। আরে বাবা, এতই যদি ব্যস্ততা, তাহলে আসা কেন বাপু ? বাইরে বেরিয়ে যত খুশি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ কোরো। এই সব লোকেরা নাটক দেখতে আসেন কেন ?
বছর দুই আগের একটি মজার ঘটনা। ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’ শো হচ্ছে কোচবিহারে। দেবশঙ্কর হালদার অভিনয় করছেন। সামনের সারিতে বসে তৃণমূলের জেলা সভাপতি (এখন তিনি উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ)। তিনি দিব্যি ফোনে জোরে জোরে কথা বলেই চলেছেন। কিছুক্ষণ সহ্য করলেন। তারপর আর থাকতে পারলেন না দেবশঙ্কর। নাটক থামিয়ে বললেন, ‘দেখুন, একসঙ্গে দুজন কথা বললে দর্শক কার কথা শুনবেন? আপনি বরং আগে কথা বলে নিন। আপনার কথা শেষ হলে আমি শুরু করব।’ রবিবাবু খুব খুশি। তাঁর সম্মানে নাটক থেমে গেল। এরপরেও তিনি কথা চালিয়েই গেলেন। তাঁর বকবক শেষ হওয়ার পর তিনি হাত দিয়ে ইশারা করলেন (মানেটা হল, এবার আপনি শুরু করতে পারেন)। ক্ষমতার দম্ভ এবং অশিক্ষা কোন স্তরে যেতে পারে, এটা তার একটা নমুনামাত্র। বিভিন্ন জেলায় যখন শো হয়, তখন রবিবাবুর মতো লোকেরাই সামনের সারিতে আলো করে থাকেন। এঁদের কিছু বলাও যায় না।
মনে পড়ে যায় পরেশ রাওয়ালের সেই অমৃতবাণী। শুরুর আগে ও বিরতিতে যদি এভাবে ঘোষণা হয়! শুনতে হয়ত খারাপ লাগবে। কিন্তু এবার সেই ঘোষণার দিন এসে গেছে।