মৌতান ঘোষাল
কলকাতা ফুটবলের মক্কা। এই শহরের মানুষের প্রায় সবারই জন্ম পরিচয়ের সঙ্গে জুড়ে যায় মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল বা মহমেডান সমর্থকের তকমা। আর তাই এই শহরের ফুটবল আবেগকে আজীবন কুর্ণিশ জানিয়ে এসেছে গোটা দেশ। এমনকি ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা ফিফাও ভারতকে আখ্যা দিয়েছে “ফুটবলের ঘুমন্ত দৈত্য” বলে। আর তাই আজকের ঝাঁ-চকচকে মার্কেটিং এর যুগে এই শহরের ফুটবল আবেগকে সম্মান জানিয়ে লেগেই রয়েছে নিত্য-নতুন কর্মকাণ্ড। কিন্তু এত কিছুর পরও কি ঘুম ভাঙছে দৈত্যের?
এবার শারোৎসবের আগে তিলোত্তমা মেতে উঠেছিল পেলে উৎসবে।৩৮ বছর পর আবার শহরে ফুটবল সম্রাট। স্বভাবতই আপ্লুত ফুটবল-পাগল কলকাতা। সঙ্গে কিছুটা নস্ট্যালজিয়াও। যে সংস্থা ফুটবল সম্রাটকে শহরে নিয়ে এল তারা প্রথম থেকেই বলেছে এটা শহরবাসীর জন্য দুর্গাপুজো’র উপহার।এমন উপহার অবশ্য আগেও পেয়েছে কলকাতা, কখনও মারাদোনা, কখনও দুঙ্গা তো কখনও ফোরল্যান রূপে। কিন্তু তারপর?
বিশ্বস্ত সূত্রে খবর, এবার পেলেকে ভারতে আনা, তাঁর থাকা, সব মিলিয়ে এই কর্মকাণ্ডে মোট খরচের পরিমাণ ১৪ কোটির কিছু বেশি। হ্যাঁ, টাকার অঙ্কটা অনেকের কাছেই চমকে যাওয়ার মত হলেও এটাই ঠিক। তবে যারা এ’নিয়ে কিঞ্চিৎ খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানেন, এই ধরনের ইভেন্টের ক্ষেত্রে টাকার এই অঙ্কটা বিশেষ চমকে যাওয়ার মতো নয়। এর আগে মারাদোনার আসার সময়ও টাকার অঙ্কটা এর কাছাকাছিই ছিল।
টাকার হিসাব দেওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সেটা না হয় পরের কোনও সংখ্যার জন্য তোলা থাক। প্রশ্ন হল এ’ধরনের উপহার তো অনেক হল, আশা করা যায় আগামিদিনেও হবে, কিন্তু এর থাকে দেশের ফুটবলের আখেরে লাভ কী হচ্ছে!
এবার ব্রাজিলীয় কীংবদন্তীর শহরে থাকা ৩ দিনের কর্মসূচী দেখেই মাথায় আসবে প্রশ্নটা।পেলে শহরে এলেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন, একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন, আর মঞ্চে সংবর্ধিত হলেন সেই ৩৮ বছর আগে কসমসের হয়ে খেলে যাওয়া তৎকালীন প্রতিপক্ষ মোহনবাগান দলের তৎকালীন সদস্যদের মধ্যমনি হয়ে। ডাউন মেমরি লেনে হাঁটলেন সে’দিনের বাংলা ফুটবলের তারকারা ।এরপর এটিকে ’র সঙ্গে ‘গালা লাঞ্চ’। আর এটিকে’র ম্যাচ দেখা। ‘এটিকে’, যে’ দলে একাধিক বিশ্বকাপ খেলা তারকার সমাবেশ, সঙ্গে দেশের দু-একজন প্রতিষ্ঠিত ফুটবলার। না, তাঁর সফরসূচির মধ্যে কোথাও কোনও ফুটবল কোচিং ক্যাম্পের খুদে ফুটবলারদের সঙ্গে সাক্ষাতের কোনও সুযোগ রাখেননি আয়োজকরা। যেমন আলাদাভাবে রাজ্যের এতগুলো কোচের সঙ্গে তাঁকে কথা বলাবারও কোন প্রয়োজনীয়তাঅ নুভব করলেন না কেউ। দেশের ভবিষ্যৎ ফুটবলাররা কতটুকু দেখতে পেলেন কিংবদন্তিকে? কতটা অনুপ্রেরণা পেল ভবিষৎ প্রজন্ম, ফুটবল খেলার জন্য? এই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই গেল। যখন যুবভারতী’র গ্যালারিতে বসে এটিকে বনাম কেরল ব্লাস্টার্সের ম্যাচ দেখছেন পেলে প্রায় সেই একই সময়ও, টানা ৫ ম্যাচ হারার নজির গড়ছে ভারতের জাতীয় ফুটবল দল। নামতে নামতে তাঁরা এখন ১৬৭!
অতীতের দিকে তাকালেও এমন প্রদীপের নিচে অন্ধকারের উদাহরণ ভুরি ভুরি। ২০০৮ সালে মারাদোনা এসেছিলেন কলকাতায়, আবেগে উত্তাল সে’দিন গোটা রাজ্য। মধ্যরাতে তিল ধারণের জায়গা নেই বিমান বন্দর চত্ত্বরে। মারাদোনার সফর সূচিতে অবশ্য ছিল মহেশতলায় ফুটবল স্কুলের উদ্বোধন। ঘটা করে ফুটবল ঈশ্বরের পায়ের ছাপ নিয়ে উদ্বোধন হয়েছিল সেই ফুটবল স্কুলের। কিন্তু আজ সেখানে কী? মারাদোনা আসার এক বছর পরই সেই মাঠে গজিয়ে উঠেছে আগাছা। লাগোয়া আবাসনের বিক্রি হয়তো কিছুটা বেড়েছিল ফুটবল রাজপুত্রের কল্যাণে, কিন্তু ফুটবল স্কু্ল? একদিনের জন্যও বল গড়ায়নি সেখানে।
দিয়েগো ফোরল্যানের আসার কারণ যে ফুটবল রিয়েলিটি শো, তার সম্পর্কে কিছু না বলাই ভাল। সেই ক্ষত যে কত গভীর তা হাড়ে হাড়ে জানেন একটা পুরো কর্মক্ষেত্র। আর সেই রিয়েলিটি শো থেকে যে ফুটবলাররা উঠে এসেছিলেন? একটা নামও মনে করতে পারছি না। অজ্ঞানতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনীয়।
তবু এমনই হয়, কখনও পুজোর আগে পেলে, কখনও পুজোর সময় দুঙ্গা তো কখনও বড়দিনের ছুটির আগে মারাদোনা, এমন উপহার বারবার পায় বাংলা। কিছুটা সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রবন্ধ “অসন্তোষের কারণ” এর মতো, যেখানে তিনি বলেছিলেন জামার পরিবির্তে এক জোড়া মোজা পেয়েই আমরা সেটাকে কেটেকুটে কীভাবে কাজে লাগাবার চেষ্টা করি। সেখানে প্রসঙ্গটা অবশ্য ছিল শিক্ষা। তবে অনেক বড় দার্শনিক ছিলেন তো রবি ঠাকুর ,তাই এক কথার উপযোগিতা একাধিক। ফুটবলের ক্ষেত্রেও কেমন মানিয়ে যায় না!!
(বেঙ্গল টাইমস পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত)