তুঘলকটা কেমন যেন চেনা চেনা

রবি কর

আমি যে একটা মাথামোটা সে বিষয়ে কারও কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। অন্তত আমার নিজের তো নেই। এবং এই মোটা মাথাটা আমার বেশ ভালই লাগে। মাথা মোটা হওয়ার অনেক সুবিধা। বেশি ভাবনা চিন্তা করতে হয় না, এডিটর কিছু লিখতে বললে, যা খুশি লিখে দেওয়া যায়। আমার কাছে কেউ বেশি প্রত্যাশা করে না। আমার তো ভালোই লাগে।
কিন্তু দিন কয়েক আগে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘তুঘলক’ নাটকটা দেখতে গিয়ে এই মাথাটাকে নিয়ে ভারি মুশকিলে পড়লাম। নাটকটা দেখে মনে হয়, এর ভেতরে কিছু একটা মানে আছে। কিন্তু মূর্খ বলে ঠিক বুঝতে পারছি না।
আপনারা জানেন, নাটক ফাটক হল বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপার। ওসব ব্যাপারে আমি থাকি না। কিন্তু বছরখানেক আগে আমি একবার মহম্মদ বিন তুঘলককে স্বপ্নে দেখেছিলাম। তাই নিয়ে একটা নাটকও লিখেছিলাম। (বেঙ্গল টাইমসের এডিটরের দয়ার শরীর, তাই সেটা ছাপিয়েও দিয়েছিলেন। কেউ পড়তে চাইলে https://www.bengaltimes.in/%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A6%BF-%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%98%E0%A6%B2%E0%A6%95-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%A8%E0%A6%AC-%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%98%E0%A6%B2%E0%A6%95/#!prettyPhoto তে গিয়ে সার্চ করতে পারেন।) এবার পুজোর আগে রবীন্দ্র সদনের সামনে ‘তুঘলক’ নাটকের বিজ্ঞাপন দেখে ভাবলাম, এটা বুঝি আমার লেখা সেই নাটক।
মনে খুব আনন্দ হল। আবার রাগও হল। আমার লেখা নাটক অথচ আমাকে একবারও জানাল না। আনন্দে নাচতে নাচতে, রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঢুকে পড়লাম একাদেমিতে। ঢুকে দেখি এটা গিরিশ কারনাডের লেখা নাটক। কী জানি, আমার থেকেই হয়ত টোকা। তাহলে তো দেখতেই হয়। পরিচালনা করেছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। দেবেশকে চেনেন তো? সেই যে যিনি ব্রাত্য বসু- অর্পিতা ঘোষের সঙ্গে নাট্য স্বজন বানিয়েছিলেন। যিনি টিভিতে, মিছিলে দিদিমণির হয়ে গলা ফাটাতেন। সেই তিনি।

debesh
আমার লেখা নাটকটার মতো অত ভালো নয়, তবে দেখতে খারাপ লাগে না। তুঘলকের শয়তানি আর পাগলামি দেখে সবাই তাজ্জব। গোল বাঁধল নাটক শেষ হওয়ার পর। দেবেশ মঞ্চে এসে বললেন, এই নাটকের সঙ্গে বর্তমান সময়ের মিল আছে।
এর মানে কী? বর্তমানে কি তুঘলকি কারবার চলছে? কোথায় চলছে? তুঘলক কি এখনও আছে? কোথায় আছে? বুঝতে না পেরে নাটকটা আরও একবার দেখলাম। দেখে কেমন একটা, “মানে আছে, মানে আছে” মনে হল। কিন্তু বুদ্ধি কম বলে ঠিক বুঝতে পারলাম না। তার ওপর আমার পাশে বসেছিল দুটো বাচাল। তারা সারাক্ষণ এটা ওটা মন্তব্য করে গেল। যাই হোক নাটকের কিছু কিছু অংশ আপনাদের জানাচ্ছি, দেখুন তো কিছু বুঝতে পারেন কি না।
নাটকের প্রথমেই আছে একটা বিচারের গল্প। কাজির আদালতে স্বয়ং সুলতানের বিচার হয়। সুলতান দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাঁর পাঁচশো মোহর জরিমানাও হয়। আসলে, সুলতান প্রমাণ করতে চান তাঁর রাজত্বে অন্যায় করলে শাসককেও শাস্তি পেতে হবে। দেখতে দেখতে আমার পাশে বসা সেই বাচাল দুটো বলল, দেখিসনি, পার্থবাবু প্রায়ই বলে, আইন আইনের পথে চলবে। এটাও সেইরকম।

tughlaq2
তুঘলক প্রজাদের অধিকার দিয়েছিলেন তাঁর সমালোচনা করার। কিন্তু সত্যি সত্যি কেউ সমালোচনা করলে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতেও তিনি দ্বিধা করেন না। সুলতানের কৌশলে শেখ ইমামুদ্দিন যখন মারা গেলেন, তখন পাশ থেকে একটা বাচাল বলল, ‘অম্বিকেশ’। কেন বলল বলুন তো ? আমি তো কিছুই বুঝলাম না।
তুঘলকের ধারণা, তিনি অপরাধী দেখলেই চিনতে পারেন। অথচ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই যে তিনিই অপরাধী।’ অর্থাৎ শুধু সন্দেহের বশেই তিনি কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন। পাশ থেকে বাচাল বলল, ‘শিলাদিত্য।’ কী যে সব বলে!
বাচাল দুটোর জ্বালায় তো আমি তিতিবিরক্ত হয়ে গেলাম। নাটকের একটা বড় অংশজুড়ে আছে রাজধানী বদলের গল্প। দিল্লি ছেড়ে তুঘলক দৌলতাবাদের সুউচ্চ কেল্লায় আস্তানা গাড়েন। বাচালরা বলল, দৌলতাবাদ কতটা উঁচু বল তো ? নবান্নের মতো হবে ? নাকি তার থেকেও উঁচু ?
তবে বাচালদের ডায়লগ ছাপিয়ে শোনা যায় এক বৃদ্ধ প্রজার ডায়লগ। তিনি বলেন, ‘ছোটখাটো পাগলামির ব্যাপারে না হয় কাজির কাছে যাওয়া যায়। রাজধানী বদল করলে কার কাছে নালিশ করব?’ দেবেশবাবু, রাজধানী বদলের সময় ওই বৃদ্ধ প্রজার নালিশ করার ইচ্ছে হয়েছিল! আপনারও কি এমন কোনও ইচ্ছে হয়েছিল? আপনি কি কোথাও নালিশ করেছিলেন?
আচ্ছা দেবেশবাবু, বেছে বেছে এই নাটকটাই কেন করলেন বলুন তো ? গিরিশ কারনাড কি অন্য কোনও নাটক লেখেননি ? নাকি ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে তুঘলকি ব্যাপার-স্যাপার দেবেশবাবুর বেশ চেনা হয়ে গেছে। কোনও রিহার্সালের দরকার পড়েনি। ডায়লগগুলো এমনিতেই তাঁর মুখস্থ।
যেমন ধরুন, সুলতানের মাথায় যে পারে, কাঁঠাল ভাঙে। কাকে বিশ্বাস করা উচিত আর কাকে ক্ষমা করা উচিত, সেটাই সুলতান বোঝেন না। ইমামুদ্দিন নামে এক শাসক সুলতানের সমালোচনা করতেন বলে সুলতান তাঁকে কৌশলে খুন করান। আবার আজিজ নামে এক খুনি সুলতানের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ঢুকে পড়ে। সুলতা্ন সব জেনেও আজিজকে ক্ষমা করে দেন। কারণ, আজিজ বারবার বলে আমি আপনার অনুগত প্রজা। আজিজের মতো চরিত্র দেবেশবাবু নিশ্চয় বাস্তবজীবনে দেখেছেন।
তবে চামচারা জানে, পাগল শাসকের থেকে সাবধানে থাকতে হয়ে। আজম নামে এক চামচা বলে, সুলতান পাগল। তাকে বিশ্বাস করবি ? যখন তখন মাথায় তোলে, যখন তখন জবাই করে। তার থেকে খোজাদের বিশ্বাস করা ভাল। এই বলে সে পালায়।
ইস, ‘স্বজন’ ছেড়ে পালানোর আগে দেবেশবাবুও যদি এই ডায়লগটা দিয়ে আসতে পারতেন!
তবে দেবেশবাবুর নাটকে শাসকদের প্রতি একটা সহানুভূতির বার্তাও আছে। তুঘলকের সৎ মা, জিয়াউদ্দিন বরনিকে বলেন, ওর এত দোস্ত আর পরামর্শদাতা আমার পছন্দ হয় না। তুমি ঠান্ডা মাথার মানুষ। সৎ, স্থির বুদ্ধি, তোমার মতো দোস্ত ওর দরকার। তিনি আরও বলেন, ‘একবার মাথায় খেয়াল চাপলেই পর মুহূর্তেই মহম্মদ কী করবে, বুঝতে পারি না।
আসলে, তুঘলকরা, অতীত বা বর্তমান যখনকারই হোক, এইরকমই হয়। তাদের চারপাশে অসৎ, ধান্দাবাজ দোস্তদের ভিড়। তুঘলকরা কখন কী করবে, কেউ জানে না। যেমন আইন উল মুলক বিদ্রোহ করল। সুলতান তাকে ক্ষমা করে দিলেন। পাশ থেকে বাচাল দুটো বলল, বদলা নয়, বদল চাই। আবার এক বিশ্বস্ত আমির সাহাবুদ্দিন ক্ষণিকের উত্তেজনায় ষড়যন্ত্র করলে নিজের হাতে তাকে খুন করলেন। বাচাল দুটো বলল, ‘এবার রাফ অ্যান্ড টাফ’।
কিন্তু তুঘলক যতই পাগল হোক, কুচুটেপনার রাজনীতি ভালই বোঝে। তার পরম শত্রুরাও বলে, আপনি দুনিয়ার চতুরতম মানুষ। রাজ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধলে তুঘলক খলিফার দ্বারস্থ হন। খলিফার প্রতিনিধি বলবেন, এই শাসক ভাল। তাহলে প্রজারা তাঁর পাশে থাকবে। বাচালরা ‘ফুরফুরা’ না কী একটা বলল।
যখন রাজ্যে দুর্ভিক্ষ, তখন সব যুগের তুঘলকরাই ঘটা করে নামাজ, দুর্গাপূজা, চলচ্চিত্র উৎসব, খাদ্য উৎসব, মাটি উৎসব প্রভৃতি আয়োজন করে। অথচ তুঘলক যখন ক্ষমতায় আসে, সবার কত আশা ছিল। সৎ মা বলেন, ‘মাত্র সাত বছর আগে তুই তখতে বসেছিলিস। তখন কী উজ্জ্বল তোর গৌরব। এখন চারিদিকে যেন মৃত্যুর কারখানা।’ বাচালরা বলল, ‘ওটা সাত বছর নয়, সাড়ে চার বছর হবে।’

tughlaq
আজিজ বলে, ‘সুলতানের খুব সন্দেহ বাতিক। শুধু সন্দেহের বশে অনেককে কোতল করেছে।’ এই সন্দেহের বিষ ছড়িয়ে যায় সুলতানের সভাসদদের মধ্যেও। সবাই সবাইকে সন্দেহ করে। একজনের উন্নতি হলে অন্যজন তার ঠ্যাং টেনে ধরে। কেউ কারও ভাল দেখতে পারে না।
সব দেখতে দেখেত কেমন যেন ‘মানে আছে’ ‘মানে আছে’ মনে হয়। তুঘলক রাতে ঘুমায় না। তুঘলক অন্যদের কবিতা শোনায়। ভাল না লাগলেও জোর করে শোনায়। বাচাল দুটো বলল, ‘হ্যাঁ রে, তুঘলক ছবি আঁকত না?’
আচ্ছা, বাচাল দুটো কেন বারবার এইসব কথা বলছে, বলুন তো ? ওরা কীসের কথা বলতে চাইছে ? দু-দুবার নাটকটা দেখেও আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। আপনার যান না, নাটকটা একবার দেখে আসুন। আপনাদের তো বুদ্ধি বেশি, হয়ত আপনারা তুঘলককে চিনতে পারবেন।

বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ
দেবেশবাবু, অর্পিতা ঘোষ কিন্তু নাটকটা দেখতে এসেছিলেন। একেবারে সামনের সারিতেই ছিলেন। তিনি যদি জায়গা মতো সব কথা বলে দেন, তাহলে কী হবে!

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.