মধুজা মুখোপাধ্যায়, নিউইয়র্ক
ডিসেম্বর পড়তে না পড়তেই চারিদিকে কেমন একটা শীত শীত আমেজ। গাছের পাতারা বহুকাল আগে এ বছরের মতো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। এই মুহূর্তে আমি যেখানে বাস করি সেই আমেরিকার নিউ ইয়র্ক রাজ্য অপেক্ষা করে রয়েছে প্রকৃতির বার্ধ্যক্যকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে নানা উৎসবের মাধ্যমে। যার অন্যতম দুটি হল বড়দিন ও ইংরিজি নববর্ষ। আমেরিকার বেশ কিছু রাজ্যে ইতিমধ্যেই ঘোরতর তুষারপাত হয়ে গিয়েছে। আমরা এখনও ভাগ্যবান যে তার দেখা মেলেনি।
কিন্ত আমাদের এখানে আপাতত “কাঠি ঋতু” বা “Stick Season” বিরাজমান। এই ঋতু হেমন্ত আর শীতের মাঝামাঝি একটি সময় যখন গাছপালাতে কোনও সবুজের চিহ্ন মাত্র থাকে না। থাকে কেবল মাত্র ধুসর গাছে কাঠির মতো শাখা প্রশাখা।
শীতের সংজ্ঞাটা এখানে একেবারে আলাদা। এখানে ঠাকুমা দিদিমার হাতের পিঠে পুলি নেই, মা মাসির হাতের করাইশুটির কচুরি নেই, কাকিমা- জেঠিমার হাতের পাটালি গুড়ের পায়েস নেই, শীতের ভোরের ময়দানে জমে থাকা কুয়াশার মধ্যে গরম চাদর গায়ে ভিজে ঘাসে হাঁটা নেই, ফিরতি পথে ট্রামের পাদানিতে দাঁড়িয়ে ভাঁড়ের গরম চায়ে চুমুক দেবার উপায় নেই, আলিপুর চিড়িয়াখানার লম্বা লাইন নেই, শীতের দুপুরে ছাদে পেলব রোদে বয়ামে ভরা আমলকিতে কড়া নজরদারি করতে করতে মাথার চুল শুকোতে দেওয়া নেই, শহরে সার্কাস এর তাঁবু ঘিরে উত্তেজনা নেই, গ্রাম বাংলার খেজুর গুড় মাখানো মিষ্টি ভোর নেই। স্বীকার করতে দ্বিধাও নেই এদেশে বসবাসের শুরু থেকেই বারে বারে দুদেশের মধ্যে তুলনা এসে গেছে। আর আমার দেশ নির্দ্বিধায় এগিয়ে থেকেছে বিশেষত এই ছোট ছোট অনুভূতির ছোঁয়া গুলোর ক্ষেত্রে। ভালো খারাপ সব দেশে সর্বকালে বিরাজমান। সেসব বিচারের দায় আমার নয়। তবে কোথাও যদি দু’দেশে মিল খুঁজে পাই সেই নিয়েই একটা অপূর্ব আনন্দ অনুভব করি আর তা উপভোগ করি। সেই রকম একটা আনন্দের মুহূর্ত হল শীতের রাতে দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের শব্দ।
আমার ছোটবেলায় আমরা যেখানে থাকতাম সেখান থেকে দক্ষিন কলকাতার মাঝেরহাট স্টেশন খুব কাছে না হলেও খুব দুরেও ছিল না। শীত কালে সম্ভবতঃ হাওয়ার দিক পরিবর্তন হত আর রাত হলেই কানে এসে পৌঁছত মাঝের হাটের ট্রেন এর whistle! Whistle এর বদলে বলা ভালো ভীষণ গুরুগম্ভীর একটা ডাক বহু দূর থেকে ভেসে আসত। মনে হত কত যুগ পেরিয়ে কেউ যেন আকুল স্বরে ডাক দিয়ে গেল। শব্দটা মোটেও তীব্র নয়, অথচ কেমন যেন রহস্যময়, মায়াবী। বেশ বুঝতে পারতাম, ট্রেনটা স্টেশনে এসে দাঁড়ালো আবার কিছুক্ষণ পর রেল লাইনে চাকা ঘষতে ঘষতে ধীরে ধীরে চিরপরিচিত শব্দটা নিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়েও গেল। কোথায় গেল বা কোথা থেকে এল এসব জানার কোনও উপায় নেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে। শুধু এটুকু অনুভব করতাম আমি যেন এই শব্দটার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমোনো যাবে।
ঠিক এমন ঘটনাটাই ঘটে আমার বর্তমান প্রবাসী ঠিকানায়। বাড়ির খুব কাছেই রেলওয়ে স্টেশন। রাতদিন Amtrack এর প্যাসেঞ্জার গাড়ি বা জিনিস বোঝাই মাল গাড়ি হয় ক্যানাডা থেকে নিউ ইয়র্ক সিটি যাচ্ছে বা উল্টোদিক থেকে ফিরছে। এই স্টেশনে আমরা বহুবার গেছি, মজার ব্যাপার হলো ট্রেন থেকে ওঠা নামার সময় ট্রেন এর whistle এ বিন্দুমাত্র রোমান্টিসিজম খুঁজে পাইনি। তা হয়ত যাতায়াতের তাড়নায়। কিন্ত চোখের আড়াল থেকে সেই শব্দের অনুভূতি একেবারে অন্যরকম। যেন মনে হয় একজন নায়ক যে সব কিছু করতে পারে তার প্রিয় মানুষটির জন্য, সে এসে দাড়িয়ে তাঁর অস্তিত্বর জানান দিল। একে যেন আমি আমার মনের সব কথা বলতে পারি। হাজার কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে তার সেই ডাক আমাকে কখনও ফাঁকি দেয়না। আচ্ছা শুধু কি আমার মন অপেক্ষা করে বসে থাকে সেই গুরুগম্ভীর ডাকের লোভে ? নাকি স্টেশনও অপেক্ষারত কখন তার প্লাটফর্মে ট্রেন এসে থামবে রাতের গভীর অন্ধকার ছিঁড়ে । সে যতক্ষণ দাঁড়িয়ে ততক্ষণ একটা উত্তেজনা অনুভব করি ভেতরে। এই নিঝুম লোকালয়ে ঘুরপাক খায়ে একটা লাগাতার যান্ত্রিক শব্দ, ‘ঘর-ঘর-ঘর’ মানে ট্রেন এখনো দাঁড়িয়ে। শব্দটার সাথে কি সেই অদেখা নায়কের হৃদযন্ত্রের যোগাযোগ আছে? আসা মানেই তো যাওয়া। তবে তার মাঝের সময়টুকু কি অপূর্ব ! এরপর একটা হালকা চেন টানার মত শব্দ, মানে ট্রেন এর পাদানির সিঁড়ি আবার গুটিয়ে বগির ভেতর ঢুকে গেল, তারপর একটা ‘হুশ’ শব্দ আরো বার দুএক whistle আর তারপর নিঝুম রাতে ছোটবেলার কু-ঝিকঝিক বোল তুলে সে ট্রেন উধাও। আমার হৃদযন্ত্র তখন ধীরে ধীরে আবার আমার নিয়ন্ত্রণে আসছে আর আমি স্বপ্নে আমার ছেলেবেলার দিনগুলোর সাথে মিলনের আশায় দিনের শেষ হাসি ঠোটে নিয়ে বালিশে মাথা রেখে চোখ বুঝছি । চলে যাওয়া মানেই আবার প্রতীক্ষা। এদেশ ওদেশ ঘুরে সে নায়ক আবার কাল জানান দেবে সে এসেছে। কত মানুষের স্পর্শ তার কাছে ,কত মানুষের গভীর গোপন কথার সে সাক্ষী। আমার মতই আমার ঘরের জানলার বাইরের বিশাল বড় ন্যাড়া গাছটাও রোজ শীতের রাতে একা একা শোনে সেই ঘন কুয়াশা ভেদ করা whistle আর দিন গোনে কবে বৃদ্ধ শীতকে বিদায় দিয়ে তার ডাল পালায় নেমে আসবে বসন্ত। একটা শব্দকে কেন্দ্র করে লক্ষ করি কতরকমের কল্পনাময় রাজ্য !
শীতের রাতের কথা যখন লিখতে বসলাম তখন Ipod এ রবি ঠাকুরের একটা গান বাজছিলো। গানটি হলো “কার মিলন চাও বিরহী” আর বাইরে ভীষন হিমেল হওয়া । ভেবে দেখলাম পরিস্থিতির সাথে কি ভীষণ ভাবে মিলে যাচ্ছে গানটা। গল্পের নায়ক কি কেবল মানুষকেই হতে হবে? কই,এমনতো কথা ছিল না ! গন্ধ, শব্দ,স্পর্শ এর মেলবন্ধনে কঠিন কঠোর শীতের রাতও হতে পারে মোহময়। এরপর শীতের রাতের অভিজ্ঞতার তালিকায় আমার পাঠকদের অনুরোধ করব কবিগুরুর এই গান খানিকে জায়গা দিতে।আর বাড়ির পাশে ট্রেন স্টেশন থাকলে তো কথাই নেই, শীতের চাদরে ঢাকা চিরপরিচিত সেই বৃদ্ধাপ্রকৃতি মাথা তুলে ঠিক জানান দেবে সেও বসন্তের সাথে মিলনের অপেক্ষায় !