কমরেড, ফিরে চলুন সেই বিকেলে

 

খোলা চিঠিঃ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

 

৬ নভেম্বর, ২০০০। এই দিনেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ষোল বছর পর, সেই দিনে তাঁকে খোলা চিঠি। লিখলেন স্বরূপ গোস্বামী।।

 

আর কদিন পরেই এই শহরে চলচ্চিত্র উৎসব। ঢেলে সাজানো হচ্ছে নন্দন চত্বর। এই কদিন নন্দনে অনেক বোদ্ধারা আসবেন। কিন্তু কেন জানি না, সেই নন্দনকে বড় প্রাণহীন মনে হবে।

অন্যদিনের মতো আজকেও সকালেই আপনার গাড়ি চলে এসেছে সোজা আলিমুদ্দিনে। সকালে কয়েক ঘণ্টা সেখানে কাটিয়ে বিকেলে হয়ত আবার আসবেন। শরীর ভাল থাকলে, মোটামুটি এটাই আপনার দৈনন্দিন রুটিন। পলিটব্যুরো থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি, দলের নীতি নির্ধারণের কোনও কমিটিতেই আপনি নেই। স্বেচ্ছায় নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। গত ছ-বছর কোনওদিন কোনও প্রেস কনফারেন্স করেছেন বলেও মনে পড়ছে না। বড় বড় সমাবেশ থেকেও অনেকটাই দূরে। নিশ্চিত করেই বলা যায়, আর কোনওদিন কোনও নির্বাচনেই আপনি দাঁড়াবেন না। ক্ষমতার কোনও দৌড়েই আপনি নেই। তবু আপনি আছেন। আপনি থাকবেন।

আগে মহাকরণ থেকে আপনার কনভয় সোজা চলে যেত নন্দনের দিকে। কতদিন আপনার প্রিয় নন্দনে যাননি! বিশ্বাস করুন, যখনই ওই চত্ত্বরে যাই, আপনার মুখটাই সবার আগে মনে পড়ে। একজন মুখ্যমন্ত্রী কত সহজভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সংস্কৃতির আঙ্গিনায়। দশটা গাড়ির কনভয় নেই। পুলিশের ছয়লাপ নেই। হেঁ হেঁ করা, ধামাধরা পারিষদরা নেই। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা, সংস্কৃতি মনষ্ক একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ। সেই দৃশ্য কি নন্দনে আর দেখা যাবে?  আচ্ছা, সন্ধেবেলায় যখন বাড়ি ফিরে আসেন, তখন নন্দনের কথা মনে পড়ে না?

buddha babu5

আজ বরং নন্দনের কথা থাক। আজকের দিনটা আপনার মনে আছে ? মনে না থাকারই কথা। পিছিয়ে চলুন ঠিক ষোল বছর আগে। এবার নিশ্চয় মনে পড়েছে। এমনই এক বিকেলে আপনি রাজভবন থেকে এলেন নেতাজি ইনডোরে। হ্যাঁ, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আজকের দিনেই আপনার অভিষেক। একদিকে জ্যোতিবাবুর বিদায়। অন্যদিকে আপনার নতুন পথ চলার শুরু।

মনে আছে, আমি আর আমার এক বন্ধু কলেজ স্ট্রীটের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে সোজা এসেছিলাম নেতাজি ইনডোরে। রাজভবনে ঢোকার ছাড়পত্র নাইবা থাকল, নেতাজি ইনডোরে তো ছিল। একই সঙ্গে জ্যোতিবাবুর বিদায় সংবর্ধনা, আর নতুন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য আপনাকে সংবর্ধনা। একদিকে বিদায়ের বিষণ্ণতা, অন্যদিকে নতুনকে ঘিরে প্রত্যাশা। সেখানে দাঁড়িয়েই বলেছিলেন, ‘আমাদের পা থাকবে মাটিতে। এই মাটি থেকে যেন কখনও সরে না যাই।’ যতদূর মনে পড়ছে, কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ স্লোগানটাও সেদিনই প্রথম শুনেছিলাম। শেষ করলেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটা কবিতা দিয়ে ‘বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’

শুরুটা তো মন্দ হয়নি। আপনি ক্রিকেটের অনুরাগী, তাই ক্রিকেটের ভাষাতেই বলি, ব্যাটের মাঝখান দিয়েই খেলছিলেন। সংবেদনশীল এক মুখ্যমন্ত্রী, সংবেদনশীল একটা সরকার। ঠিক ছ মাসের মাথায় বিধানসভা নির্বাচন (২০০১)। বিরাট জয় এল আপনার নেতৃত্বে। পরের পাঁচটা বছর দম ফেলারও ফুরসত ছিল না। রাজ্যে শিল্প আনার জন্য সমানে লড়াই করে যেতে হয়েছে। উন্নয়নে একেবারেই সামনের সারিতে উঠে আসছিল আমাদের বাংলা। এমনকি যে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বরাবর মুখ ফিরিয়ে থাকত, বাসে-ট্রামে-মেট্রোয় নানা টিপ্পনি কাটত, তাঁরাও দেখলাম, বাম অনুরাগী হয়ে পড়ছেন। ‘বুর্জোয়া’ কাগজেও সুরবদল! বলা হল, সিপিএম খারাপ হলেও আপনি ভাল। পরেরবার তো (২০০৬) জয় এল আরও বড় ব্যবধানে। জয়ের দিনই এসে গেল টাটার কারখানার ঘোষণা। বুদ্ধ থেকে একেবারে ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’। সব ঠিকঠাকই তো চলছিল। তারপর কী যে হয়ে গেল!

buddha babu4

এখন সভ্যতার রথ যেন উল্টোপথে চলছে। কৃষি থেকে শিল্পে উত্তরণ নয়। এখন কারখানা ভেঙে জমি ফেরানোর সংস্কৃতি। কর্মসংস্থান নয়, মাথা উঁচু করে বাঁচা নয়, দু-টাকার চাল, ক্লাবের অনুদান, আর নানা দাক্ষিণ্য বিতরণের সংস্কৃতি। এখন তো আপনি একেবারেই ভিলেন। তা মশাই, আপনার অপরাধটা কী ছিল ? একটা রাজ্যকে নিজের পায়ে শক্ত জমির উপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। রাজ্যে শিল্পের একটা সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ভারী অন্যায়। জানেন না, এতবড় ঝাঁকুনি এই জাতিটার সহ্য হয় না। সিঙ্গুরে আপনার কোথায় ভুল ছিল, কী করা উচিত ছিল, তা নিয়ে পাড়ায়, রকে, বাসে, সোশাল সাইটে নানা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনি। মনে হয়, সবাই সবাই সবজান্তা। সবাই সবকিছু বোঝে, শুধু আপনিই বোধ হয় বোঝেননি।

বাঙালি জাতিটা সত্যিই বড় আত্মবিস্মৃত জাতি। সে অতীত মনে রাখে না। সে বড়ই হুজুগপ্রিয়। কে তাদের ভাল চায়, সে বুঝেও বোঝে না। কারখানা ভেঙে আবার চাষের জমি বিলিতে সে উৎসব করে। সব কাগজ, মিডিয়া ধন্য ধন্য করে। নির্লজ্জ স্তাবকতায় ছেয়ে যাচ্ছে রাজ্য। আর এই স্তাবকতা কেউ কেউ কী দারুণ উপভোগ করছেন। কোনটা সরকারি অনুষ্ঠান, কোনটা দলীয় অনুষ্ঠান, সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কত নিচে নামতে পারে, রোজ তার ভুরি ভুরি উদাহরণ। দিকে দিকে দল ভাঙানো। বিরোধীদের হাতে থাকা একের পর এক পঞ্চায়েত, পুরসভা, জেলা পরিষদ দখল হয়ে যাচ্ছে। কোথাও লোভ দেখিয়ে, কোথাও ভয় দেখিয়ে। কই, আপনার সময় তো এমনটা হত না। হত না, কারণ আপনি চাইতেন না।  এখন হয়, কারণ ‘তিনি’ এটাই চান।

buddhadeb bhattacharya3

বিশ্বাস করুন, নানা সময়ে আপনার কথা মনে পড়ে। অস্বীকার করব না, কোনও কোনও ব্যাপারে আপনার উপর রাগ বা অভিমান হত (হয়ত ভালবাসতাম বলেই হত)। কিন্তু এখন যখন প্রতিদিন নির্লজ্জ মিথ্যের বেসাতি শুনি, যখন প্রতিদিন নিচুস্তরের অসভ্যতা দেখতে হয়, তখন বুঝতে পারি, আপনি কতটা আলাদা। আপনার কথায় উঠে আসত সুস্থ রুচি, আর এখন উঠে আসে খেউড়। ওই চেয়ারে বসে দিনের পর দিন এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলা যায়! যায় তো, দেখছি তো। দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে বলেই এখন আর রাগও হয় না। কিন্তু রাজ্যের মানুষ কি এখনও বুঝছে তাঁরা কার জায়গায় কাকে বসিয়েছেন! মাঝে মাঝে মনে হয়, বেশ হয়েছে। আমরা যেমন, ঠিক তেমন মুখ্যমন্ত্রীই পেয়েছি। এমনটাই তো আমাদের প্রাপ্য ছিল।

 

কমরেড, এ বড় সুখের সময় নয়। একদিকে বাইরের আক্রমণ, একদিকে দলকেও নতুন করে সাজানোর লড়াই। দুদিকেই এক অদ্ভুত অসহিষ্ণুতার আবহ। ধর্মীয় মেরুকরণ আরও স্পষ্ট হবে।  কেউ কেউ বিকৃত আনন্দে চিৎকার করবে, সিপিএম ফিনিস। কমরেড, জানি পথটা কঠিন। তবু বলব, লড়াইয়ের ময়দানেই থাকুন। জানি, শরীর আর তেমন সঙ্গ দিচ্ছে না। মিটিং মিছিলে যাওয়া কঠিন। তবু সক্রিয় থাকুন। চিন্তায়-চেতনায় দলকে আরও সমৃদ্ধ করুন। দল যেন সঠিক রাস্তায় থাকে, নীরবে সেই লড়াইটা অন্তত করে চলুন।

সন্ধে নেমে আসবে। রাত গভীর হবে। কোনও একটা ভাল বই পড়ুন। আর অন্তত আজকের দিনে, একটু স্মৃতির পাতায় ডুব দিন। ফিরে চলুন ষোল বছর আগের সেই বিকেলে।

 

Share

1 comment

Satrajit Chatterjee says:

” দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে বলেই এখন আর রাগও হয় না। কিন্তু রাজ্যের মানুষ কি এখনও বুঝছে তাঁরা কার জায়গায় কাকে বসিয়েছেন! মাঝে মাঝে মনে হয়, বেশ হয়েছে। আমরা যেমন, ঠিক তেমন মুখ্যমন্ত্রীই পেয়েছি। এমনটাই তো আমাদের প্রাপ্য ছিল।”

I specially admire to thise line. Waah !! This is also my “Man Ki Baat”.

Really ,The Bengalees got a CM now as per their culture, as per their present taste.-( আমরা যেমন, ঠিক তেমন মুখ্যমন্ত্রীই পেয়েছি। এমনটাই তো আমাদের প্রাপ্য ছিল।”)

Shame on this Spineless Bengalees !!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.