অনামী “তিন কন্যা”

আজ ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। কাগজে, চ্যানেলে সেলিব্রিটি নারীদের লেখা, সাক্ষাৎকার, আরও কত কী ? কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে লড়াই করছেন নারীরা ? তেমনই তিনজন সাধারণ নারীর অসাধারণ লড়াইয়ের কথা তুলে আনলেন মৌতান ঘোষাল।

“তুমি দেখেছো কি অগুন্তি মানুষের ভীড়ে মিশে যাওয়া কোনও এক মেয়ে?” দেখেছি আমরা সবাই, তবে বড় আলগা দৃষ্টিতে, কখনও ভাবিনি বেশিক্ষণ। কেনই বা ভাববো ? সে সেলিব্রিটি নয়, বা তাঁর জীবনে কোনও গল্পও তো আমরা জানিনা। সে সাধারণ, আপনার আমার চেনা চারপাশের বহু মেয়ের মতোই খুব সাধারণ। আর তাই পুরুষ শাসিত এই পৃথিবী’র সবথেকে উদাররতা’র দান এই ‘নারীদিবসে’ও আলোচনা হয় সেই নারীদের নিয়েই যারা বিশেষ। বিশেষ নিজের কৃতিত্বে বা চূড়ান্ত কোনও দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে, উঠে এসেছেন খবরের কাগজের পাতায়। কিন্তু এর বাইরের পৃথিবীটা ?এর বাইরের এই তথাকথিত সাধারণ ‘নারী’রা? তাঁদের কথা কখনও বলা হবে না! আরে বাবা, অতি সাধারণ কোনও এক হরিপদ কেরানি’র জীবনটাও তো একটা গল্প নাকি? মানছি তা রূপকথা’র মতো সুন্দর নয় তবু একটা জীবন তো? আর জীবন যখন চলছে, গল্পও তো থাকবে একটা। আজ তাই এই নারী দিবসে কিছু ‘সাধারন মেয়ে’র কথা বলি।

ভাবছেন তো বিবর্ণ কোনও আতলামি ভরা দুখীঃ জীবনের পরিসংখ্যান দেব ? একেবারেই না। দুঃখী নয়, দুখঃকে এক হাসিতে উড়িয়ে দেওয়া কিছু “মানুষের” কথা বলবো।

আজও ভারতী যখন কাজ করতে এসেছিল আমি ঘুমচ্ছিলাম। আমার মায়ের সঙ্গে ওঁর অনেক কথা থাকে রোজ। ভারতী কে? ও হ্যাঁ তাই তো বলা হয়নি। এতো সাধারণ যে… ভারতী আমাদের বাড়ি ঘর মোছা বাসন মাজা’র কাজ করে। আর সেই কাজের ফাঁকে মায়ের সঙ্গে অনেক গল্পও করে। তাই জানতে পারলাম, ভারতী নিজে লেখাপড়া করেনি, তবে ওঁর এক ছেলে এক মেয়ে, মেয়ে পড়ে ক্লাস সেভেনে, আর ছেলে ফাইভে। দুজনেই এখানকার বেশ নামী সরকারী স্কুলে পড়ে। তবে এই পড়া’র খরচ চালাতে গিয়ে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হচ্ছে ওঁকে। বর মাঝে মাঝে আসে, মারধোরও করে তবে সেটা অধিকাংশ সময়ই লুকিয়ে যেতে চায় ভারতী। কী হবে নিজের এই লজ্জাটা সবার সামনে তুলে ধরে ? পুলিশ, আইন, এসব করার সাধ্য নেই ওর । বোধ হয় ইচ্ছেও নেই। তাই কিছুটা অসহায়ভাবেই মেনে নেয়। শুধু অপেক্ষা ছেলে মেয়েটা মানুষ হয়ে যাক। তারপর না হয়…। এক-এক দিন আমার মায়ের কাছে আগের দিন অন্য কাজের বাড়িতে দেখা মেগা ধারাবাহিকের বাকি থেকে যাওয়া গল্পের অংশটুকু শুনে নেয় ভারতী। হাল্কা ঘুমের মধ্যে এক এক দিন শুনতে পাই আমি। কী জানি হয়তো বাংলা ধারাবাহিকের চির বঞ্চিত নায়িকার অপার দুঃখ দেখে নিজের দুঃখ’র সান্ত্বনা খোঁজে ও। আবার অতোশতো নাও ভাবতে পারে । কারণ, ছেলে-মেয়ে’র পড়াশোনা, ঠিকমতো স্কুলে যাওয়া, উঠতি বয়সে বিগড়ে যাতে না যায় নিজের কাজের মাঝখানে সেদিকে খেয়াল রাখা, এসব নিয়েই কেটে যায় ওঁর। কে জানে ধারাবাহিকের নায়িকার মত গল্পের শেষে ওর দুঃখ দূর হবে কিনা!

nari dibas2

পার্ক সার্কাসের চা-মাসী’র নামটা গত ৮বছরেও জানা হয়ে ওঠেনি, না জেনেছিলাম বোধহয়, ভুলে গেছি, আসলে মাসি বলেই তো ডাকতাম! মাসি’র ধর্ম ইসলাম। খুব সাত্তিক ভাবে ধর্ম পালন করে মাসি। আর ফুটপাথের উপর চায়ের দোকান চালায়। দোকান বলা ভুল হবে। মাথায় ছাত নেই। ফুটপাথে উপর একটা দোকানে’র সামনে উনুন ধরিয়ে চা বানায়। কবে থেকে জানি না। বাকি চা বিক্রেতাদের সঙ্গে কম্পিটিশনে এঁটে উঠতে মাসি’র ফর্মুলা অভিনব। আসপাশের উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি’র অফিসগুলো সিঁড়ি বেয়ে চা পৌঁছে দেয় মাসি। তাতেই বাড়তি রোজকার। আমার সঙ্গেও আলাপ সেই সূত্রেই। মাসি’র স্বামী মারা গেছেন বহু দিন হল। তিন মেয়ে, এক ছেলে। তিন মেয়েকেই পড়াশোনা শিখিয়েছে, সেলাই শিখিয়েছে। তাঁদের দুজনের বিয়েও দিয়েছে। দুই মেয়েকে সাবলম্বী করেছে মাসি। একজন এখনও পড়াশোনা করছে। ছেলেকেও পড়াশোনা শিখিয়েছে তবে সে আজকাল…থাক সেটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ মাসি’র লড়াইটা, যেটা চিরকাল হাসি মুখেই লড়ে গেলেন মহিলা। প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের দায়িত্বে নিজের মেয়েদের সমাজের উপযুক্ত, আর সাবলম্বী করে তোলা’র লড়াইটা। শত কন্টকিত নিজের জীবনটাকে কীভাবে নিজেই জাহান্নম থেকে জন্নত বানিয়েছে মাসি, তা সে নিজেও জানে না।

লজেন্স মাসি’র কথা আগেও লিখেছি। অনেকেই লিখেছে, তাই যমুনা দাসের বাকি দু’জনের থেকে এখানে একটু ‘বিশেষ’। যারা ফুটবল মাঠে যান তাঁরা যমুনা দিকে চেনেন, তবে চেনেন লজেন্স মাসি নামে। খেলোয়াড়রাও ওই নামেই জানে। মাসি ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, তাঁর লজেন্সের রঙও লাল হলুদ। তবে সব খেলাতেই মোটামুটি তাঁকে দেখা যায় নিজের লজেন্সের ভান্ডার হাতে নিয়ে। বেলঘরিয়া পেরিয়ে আগরপাড়ায় বাড়ি মাসি’র। স্বামী কী করেন, জানা নেই। ময়দানে লজেন্স বিক্রি করেই সংসার চলে মাসির । কবে থেকে? সে বহুকাল, দিণ ক্ষণ কে মনে রেখেছে? এ কী সুনিতা উইলিয়মসের মহাকাশে হাঁটা যে ডেট মনে রাখতে হবে বা মনে না রাখলেও গুগলে সার্চ করলে পাওয়া যাবে!

তবে হ্যাঁ এই মানুষগুলোকে মনে রাখতে হবে। না, ওঁদের নাম হয়তো মনে থাকবে না, কিন্তু নিজের আসপাশে একটু চোখ কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবেন ওঁদের। ওঁরা যে সংখ্যায় অনেক। আর হ্যাঁ অবশ্যই “বিশেষ”। নিজের মতো করে। নিজের জীবনে’র গল্পে ওঁরা “হিরো”।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.