জয়রামবাটী বা কামারপুকুরের নাম তো আপনারা সবাই শুনেছেন। বেড়াতে যাওয়ার পক্ষে আদর্শ জায়গা। অনেক দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ আসছেন। কিন্তু জানেন কি কোয়ালপাড়া মঠের কথা? জয়রামবাটী থেকে মাত্র চার মাইল। যদি বাঁকুড়া বা বিষ্ণুপুর থেকে যান, তাহলে জয়রামবাটী যাওয়ার আগেই পেয়ে যাবেন এই কোয়ালপাড়া।
এর আগে ও পরে অনেক মঠ বা মিশনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু কেন জানি না, আড়ম্বরবিহীন এই কোয়ালপাড়ার কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। এখানে আমার স্মৃতি বলতে, বছর তিনেক আগে কাটানো একটি দুপুর। সেই দুপুরটা মনের মধ্যে গভীর এক ছাপ ফেলে গিয়েছে। সকাল নটার মধ্যে এখান থেকে প্রসাদী কুপন সংগ্রহ করে চলে গিয়েছিলাম জয়রামবাটী। সেখানে তো অস্বাভাবিক ভিড়। যদিও সেটাই হওয়া স্বাভাবিক। প্রসাদ খাওয়ার লাইন দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। জয়রামবাটী ও কামারপুকুর ঘুরে ঠিক বারোটার মধ্যে ফিরে এলাম কোয়ালপাড়ায়।
শাল গাছের জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট এক গ্রাম। তার মাঝখানে নির্জন এক আশ্রম। কিন্তু এই কোয়ালপাড়ার বিশেষত্ব কী? এখানে এমন আশ্রম কেনই বা গড়ে উঠল? বিস্তারিত ইতিহাস লিখতে গেলে, সে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তবে একটু ছুঁয়ে যাওয়া উচিত। এই জায়গাটির সঙ্গে মা সারদার দীর্ঘ এক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কলকাতা যাওয়ার পথে এই শান্ত, স্নিগ্ধ গ্রামটিতে তিনি প্রায়ই আসতেন। পথের ক্লান্তি দূর করতে একটু জিরিয়ে নিতেন। নিজের হাতে রামকৃষ্ণ ও তাঁর ছবি প্রতিষ্ঠা করেন। তার পর থেকেই এটি মঠ হিসেবে পরিচিত হয়। সেখানেই এখন স্থায়ী মঠ। কোলাহল থেকে দূরে, একেবারেই নির্জনে চলছে বিরাট এক কর্মকাণ্ড।
আবার আমাদের কথাতেই আসি। ভেতরে যেতেই দেখলাম, আমাদের জন্য একেবারে গুরুর আদরের ব্যবস্থা। ছোট্ট ছোট্ট টেবিলে আমাদের জন্য পরম যত্নে খাবার সাজিয়ে রেখেছেন আশ্রমিকরা। পোলাও, ভাত, আলু পেঁয়াজ পোস্ত, পুকুরের টাটকা মাছের ঝাল, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি–সে এক এলাহি ব্যাপার। পেট পুজো তো হল। বাঙালি খেতে পেলেই শুতে চায়। ভরপেট খেয়ে কেউ আর নড়তে পারছে না। মন বলছিল, সারদা মায়ের মতো আমরাও যদি একটু জিরিয়ে নিতে পারতাম! কিন্তু আশ্রমে শোব কোথায়?
আমাদের অবস্থা বুঝতে পেরে, এগিয়ে এলেন ভীম মহারাজ। উনি আমাদের নিয়ে গেলেন ওপর তলায়, তাঁর নিজের ঘরে। মাদুর, কম্বল, বালিশ নিজেই বিছিয়ে দিলেন। বললেন, মা জননীরা সব বিশ্রাম করুন। এমন আন্তরিকতা দেখে অভিভূত হলাম। গ্রামের মানুষদের সঙ্গেও উনি কী চমৎকার সাবলীল। রাস্তায় যেতে যেতে বেশ কয়েকটি বাচ্চার সঙ্গে দেখলাম তাঁর দারুণ দোস্তি। কখনও ব্যাগ থেকে বের করে তাদের চকোলেট দিচ্ছেন। কখনও তাদের কাছ তেকে আবৃত্তি শুনছেন।
আশ্রমের চারিদিকটা কী নির্জন, নিস্তব্ধ। ভাবছিলাম, জীবনের কত না পাওয়াকে এঁরা হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। আশ্রমিকদের আন্তরিক ব্যবহার মন ছুঁয়ে গেল। রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজিদের কল্পলোকের বাসিন্দা বলেই মনে হত। কিন্তু তাঁরাও যে আমাদের মতো সাংসারিক মানুষের সঙ্গে এত সাবলীলভাবে মিশতে পারেন, ভাবিনি। যখন ফিরে আসছিলাম, তখন শালবনের ভেতর দিয়ে সন্ধ্যে নামছে। গ্রামের মহিলারা টোকার ভেতর প্রদীপ নিয়ে সন্ধ্যে দিচ্ছেন। মন্দিরে আশ্রমিকদের একটানা ধীর লয়ে আরতি আর স্তোত্রপাঠ যেন অন্য এক আবেশ এনে দিল। সেবার আমাদের থাকা হয়নি। ফিরে আসতে হয়েছিল। কিন্তু আপনি চাইলে সেখানে থাকতেও পারেন। হলফ করে বলতে পারি, ভাল লাগবেই। দৈনন্দিন ব্যস্ততা তো আছেই। তার মাঝেও একটা ছুটির দিন খুঁজে নিয়ে একটু ঘুরেই আসুন। নিজের জেলাকে একটু অন্যভাবে চিনুন।