শ্রীকান্তর পঞ্চম খণ্ড কেন যে লিখলেন না!‌

‌অন্তরা চৌধুরি

‘একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু,
নিতান্ত সাধারণ মেয়ের গল্প’
জানি না। সাধারণ মেয়ে মালতীর গল্প আপনি লিখেছিলেন কিনা। কিন্তু এমন অনেক অসাধারণ গল্প যে লিখেছেন তা নিয়ে তো কোনও দ্বিমত নেই। আপনি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র। যাঁর লেখা আজও পাঠক সমাজে জনপ্রিয়। আমি কিন্তু আপনার সব লেখা পড়িনি। জানি, এটা কোনও গর্বের কথা নয়। কিন্তু কিছু কিছু তো পড়েছি। আর যা পড়িনি, তা পড়ব জীবনের অপরাহ্ন বেলায়। কারণ, ভাল খাবার তো সবসময় শেষ পাতেই খেতে হয়।
যখন ছোট ছিলাম তখন বাবার পাশে শুয়ে শুয়ে মেজদার গল্প শুনতাম। মেজদা নাকি নিজে ম্যাট্রিকে তিনবার ফেল করেছে। অথচ ভাইদের প্রতি তার কী কড়া শাসন। জল খাওয়া। হুঁ। আটটা তিপ্পান্ন থেকে আটটা পঞ্চান্ন। সে যে কী মজাই লাগত মেজদার গল্প শুনতে। তারপর সেই ছিনাথ বহুরূপী আর পিসেমশাই এর অমোঘ ডায়লগ-‘লাও তো বটে কিন্তু আনে কে?’ যখন বড় হলাম, হাতে পেলাম ‘শ্রীকান্ত’।
হাতে চাঁদ নয়, যেন সমুদ্র পেলাম। এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়ে ফেলেছিলাম। নতুনদার কথা খুব মনে পড়ে। এমন চরিত্র বাংলা সাহিত্যে আর কোথাও পেয়েছি বলে মনে হয় না। সবথেকে কষ্ট হয় ইন্দ্রনাথেরর জন্য। ইন্দ্র দেবতা না মানুষ–‌ওই জায়গাগুলো কতবার যে জোরে জোরে পড়তাম আর কাঁদতাম! অন্নদা দিদির কথা যতবার পড়তাম ততবার মনে হত আমার যদি এমন একটা দিদি থাকত!

sharatchandra5
তারপর যেদিন ‘শ্রীকান্ত’ পুরো চারটে খণ্ডই পড়ে শেষ হয়ে গেল, সেদিন আপনার ওপর খুব রাগ হয়েছিল। কেন যে এরকম আরও চারটে খণ্ড আপনি লিখলেন না? আপনিও লিখে যেতেন আর আমরাও পাতার পর পাতা পড়ে যেতাম। আপনি অমর কথাশিল্পী হওয়া সত্ত্বেও কেন লিখলেন না বলুন তো? ক্লাস সিক্স থেকেই ‘মহেশ’ পড়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন একবারের বেশি দুবার পড়তে পারিনি। মহেশের কষ্টটা যেন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতাম। এত কষ্ট কেন দিলেন মহেশকে আপনি! গফুর আর আমিনার কী হয়েছিল জানতে চাই না। কিন্তু যাদের কসুর মাফ না করার কথা সেদিন গফুর বলে গিয়েছিল তাদের পরিণতি কী হল! ‘অভাগীর স্বর্গ’ পড়েও ভেতরটা মোচড় দিত। যদি বলি অপরের কষ্টে কাঁদতে আপনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন, খুব কি ভুল বলা হবে?
‘ঝিনুকের দুটি খোলা, মাঝখানটুকু ভরা থাক একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে, দুর্লভ, মূল্যহীন।’ আমার মা দেখতাম আপনার বই খুব পড়ত। লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে পড়ত আমার দিদা। তখন সিরিয়াল ছিল না। বই ছিল। খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের চৌহদ্দিতে আটকে থাকা মা–কাকিমাদের কাছে সেটাই ছিল অক্সিজেন। অলস দুপুরে মা কাকিমা আপনার লেখা নিয়েই আলোচনা করেছে। তর্ক করেছে। বাঙালির চিরাচরিত পিএনপিসি!‌ তাও সেই আপনার লেখা নিয়েই। গল্পের ওই চরিত্রটার সঙ্গে আশেপাশের কোন চরিত্রের কতটা মিল, তা নিয়ে চলত ফিসফিস। তাদের কথা শুনে মনে হত ঘটনাগুলো যেন তাদের সামনে ঘটছে।
কিশোরী বয়স থেকে কাকিমার কাছে চুপিচুপি দেবদাস–পার্বতীর প্রেমের গল্প শুনতাম। নিষিদ্ধ আলোচনার সেই বোধ হয় হাতেখড়ি। একটু একটু করে যেন বেড়ে উঠছি। আর অন্য কোনও উপন্যাস কাকিমা পড়েছে কিনা জানি না, কিন্তু ‘দেবদাস’ পড়েছে। সেইসময় সব প্রেমিক–‌প্রেমিকারাই নাকি দেবদাস–‌পার্বতী হতে চাইত। তাদের মতো ভালবাসতে চাইত। দেবদাস বা পার্বতী হলে সারাজীবন কাঁদতে হবে, এটা জেনেও কেন যে লোকে এসব হতে চাইত, কে জানে!‌ আর আপনার দেবদাস পার্বতী তো এখন প্রেমের ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসাডর হয়ে গেছে। আপনার দেবদাস তো মরেনি। সে আজও বেঁচে আছে এবং চিরকাল বেঁচে থাকবে পাঠক হৃদয়ে। উপন্যাসটা পড়ার আগেই সঞ্জয় লীলা বনশালীর সিনেমাটা দেখেছিলাম। তখন আমি ইলেভেনে পড়ি। সিনেমাটা দেখার পর সাতদিন কিছু পড়াশোনা করতে পারিনি। আচ্ছা, যে লেখা পড়ে মানুষ কাঁদে সেই লেখাই জনপ্রিয় হয় কেন? আপনার অধিকাংশ লেখা পড়েই খুব কষ্ট হয়। দুঃখই তো মানুষের কাছে ঐশ্বর্য হয়, তাই না! আপনি সারাজীবন ধরে মানুষকে কান্নার আনন্দ দিয়ে গেলেন। কিন্তু আপনার মতো মহাপ্রাণ আজ পর্যন্ত আর কটাই বা সৃষ্টি হল! আপনার জন্মদিনে এটুকুই আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.