গল্প: অ-আ-ক-খ

কুণাল দাশগুপ্ত

জীবনের যত কোলাহল সব অ্যালকোহলেই খুঁজে পেত সবুজ। কাব্য করে বলত, কত সন্ধ্যা রঙিন হয় লাল রঙের এই জলে, কত গ্লাসের গায়ে জমে কত আবেগের বিন্দু।

এই বিলাসিতাকে এক ইঞ্চিও প্রশ্রয় দিতে চায়নি তার চাকরিরতা স্ত্রী অনসূয়া। অশান্তির বর্ষা অমঙ্গল ডেকে আনত প্রতি রাতে। নিয়ম করে।

দূরত্ব ছিল আরও একটা বিষয়েও। রাজনীতি। সবুজের বাম বিরোধিতা ছিল অকৃত্রিম। সর্বহারা, শ্রেণিহীন সমাজ জাতীয় শব্দগুলো গা জ্বলিয়ে দিত তার। উল্টোদিকে অনসূয়া বাম কর্মচারী সংগঠনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। মিটিং, মিছিল তার কাছে সঙ্গীতশিল্পীর গলা সাধার মতো নিত্য দিনের কাজ।

অশান্তি, ঝগড়ার অন্তাক্ষরী চলার সময়ে কখনও কখনও অনসূয়ার অ–‌আ–‌ক–‌খ সিরিজের বাম বইগুলো ছুঁড়ে ফেলেছে। অশালীন শব্দ প্রয়োগ করে সমাজতন্ত্রের অসারতার কথাও বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে চৌত্রিশ বছরের বাম রাজত্ব রাজ্যকে সাড়ে বত্রিশভাজা করেছে। অনসূয়াও বলেছে, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, ক্ষুদ্র শিল্প, ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত, কৃষিতে এই রাজ্যটাই এগিয়েছিল। আসলে, বাম বিরোধিতা করতে গেলে লেখাপড়া না করলেও চলে। কিন্তু সমর্থন করতে গেলে একটু আধটু পড়তে হয়। তোমার বিজ্ঞান জ্যোতিষ আর জড়িবুটি। আমার বিজ্ঞান বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।‌

সবুজ লম্বা। ছিপছিপে। বেসরকারি কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের জিএম। বৈভবের চিলেকোঠায় বসে রয়েছে।

আরও একটা গুন রয়েছে। মেয়েদের মনকে প্রভাবিত করতে পারে ‘‌ঘরে–‌বাইরে’‌র সন্দীপের মতোই। সুতপার মনে হানাদারি চালিয়েছে একেবারে এক্কেবারে সবুজীয় কায়দায়। শরীর–‌মন দুটোই মাখামাখি করেছে দুজনে। পার্ক স্ট্রিটের হোটেলগুলো প্রতি সন্ধ্যায় সত্যযুগের বৃন্দাবন হয়ে যেত। প্রাচ্যের আরব্য রজনী বললেও অত্যুক্তি হয় না।

অন্যদিকে, অনসূয়া মন দিয়েছিল রাজনীতি আর তাদের দশ বছরের ছেলে অনীকের লেখা পড়ার বিষয়ে। আসলে, কাটখোট্টা রাজনীতির পাশাপাশি সংসারে শান্তির ফুল ফোটানোরও একটা স্বপ্ন ছিল তার। অফিস, রাজনীতি আর ছেলে মানুষ করাই ছিল অনসূয়ার জীবনের সিম্ফনি।

সূর ছিটকালো, যখন জানতে পারল সবুজ–‌সুতপার ব্যকরণ বহির্ভুত সম্পর্কের কথা। সেদিনই হৃদয়ের ঝাঁপ ফেলে দেয় সে। তারপর একদিন সরকারি তালা। ডিভোর্স হয়ে যায়।

ধীরে ধীরে পচন ধরে সবুজ–‌সুতপার কৃত্রিম প্রেমে। সবুজও বুঝতে পারে, বউ আর ‘‌বউয়ের মতো’‌র মধ্যেকার ফারাকটা।

অতিরিক্ত মদের ফলে বিবর্ণ হয়েগিয়েছিল সবুজের স্নায়ুগুচ্ছ। অবসাদ আর অপরাধবোধ পিশাচের নৃত্য চালিয়ে যায় মনের মধ্যে। বুঝতে পারে সর্বহারা কাকে বলে।

বড্ড মনে পড়েছে অনসূয়ার কথা। অতঃপর কড়া নাড়ে প্রাক্তন হয়ে যাওয়া শ্বশুরবাড়ির দড়জায়।
শীর্ণকায় সবুজ অনসূয়াকে বলে, শেখাবে একটু বাম রাজনীতির অ-আ-ক-খ?
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.