বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্তর গল্প

‌গল্প

দিকভ্রান্ত পথিক

বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত

শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে এক বৃষ্টি ভেজা সকাল। গত কয়েকদিন ক্রমাগত বৃষ্টির পর আজ সকালে বৃষ্টির প্রকোপটা একটু কমলেও সারা আকাশ জুড়ে কালো মেঘের সম্ভার আর একটা থমথমে ভাব। কলকাতার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহিরবিভাগে এই সময়টায় প্রচুর লোকের সমাগম। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে ডাক্তার দেখাবার পর রুদ্রশেখর দু’‌হাতে স্ক্রাচে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে বেরোবার সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরে ফেরার জন্য । হঠাৎ আবার জোরে বৃষ্টি নামল। অগত্যা লোকজনের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হল বৃষ্টির তোড়টা একটু কমার অপেক্ষায়। আর এই লোকজনের দাঁড়িয়ে থাকা ভিড়ের মধ্যে একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে বহু বছর পর তার সঙ্গে দেখা।

একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে চশমার ভারী কাঁচটা ভাল করে মুছে নিয়ে তাকিয়ে দেখে নিশ্চিত হলেন তিনি ভুল করেননি। ঠিকই দেখেছেন। বয়সজনিত কারণে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এখন হাতে লাঠি, চোখে চশমা। কিন্তু এখনও ভাল করে দেখলে বোঝা যায়, একটা সময়ে সে অপরূপ সুন্দরী ছিল। সে হয়ত তাঁরই মতো বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনের দিক থেকে একেবারে নিশ্চিত হয়ে সমস্ত সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে তার সামনে গিয়ে রুদ্রশেখর বললেন,
— ইন্দ্রাণী, কেমন আছ? আমাকে চিনতে পারছ? বহু বছর পর হলেও আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক চিনতে পেরেছি।
কিছুটা বিস্ময় মিশ্রিত দৃষ্টি দিয়ে একটু সময় নিয়ে ইন্দ্রাণী বেশ উচ্ছ্বসিত আর আবেগপ্রবণ হয়ে বলল,
— রুদ্রদা তুমি এখানে! কেমন আছ রুদ্রদা? সত্যি, তোমার সঙ্গে আমার প্রায় বহু বছর পর দেখা! ভাবতেই পারিনি তোমার সঙ্গে এত বছর পর এখানে দেখা হয়ে যাবে! তোমার দু’‌পায়ের এই অবস্থা কেন?
রুদ্রশেখর একটা ছোট নিরাশ হাসি দিয়ে বললেন, পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় এটা তাদের তরফ থেকে আমাকে দেওয়া অত্যাচারের একটা উপহার মাত্র।
ইন্দ্রাণী একটু গম্ভীর কিছুটা হতাশ হয়ে একটুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমি তো এমনটা চাইনি, রুদ্রদা। বিশ্বাস কর, সেদিনের ক্ষণিকের অভিনয়কে মনের দিক থেকে আমি বাস্তব হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সময় কম থাকার দরুন তোমাকে আমার মনের সব কথা শীঘ্র খুলে বলব, কিন্তু সেই সুযোগ আমি আর পেলাম না। তার আগেই …… ।
রুদ্রশেখর কথা থামিয়ে বললেন, আমিও তোমার মনোভাব কিছুটা আঁচ করতে পেরে মনের দিক থেকে বেশ দুর্বল হয়ে তোমাকেও কিছু বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা সেদিন যে মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলাম সেই সময় সেটা কোনও মতেই সম্ভব ছিল না। পরে অবশ্য উপলব্ধি করি আমি হয়ত সেদিন ভুল করেছিলাম। এখন থাক সেসব পুরোনো কথা, এবার তোমার কথা বল। এখন কোথায় আছ?

ইন্দ্রাণী কিছুটা ক্লান্তভাবে বলল, অনেক চিন্তাভাবনা করে সংসার ধর্ম আর করলাম না। বর্তমানে কাছেই এক বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। মাঝে মাঝে হাসপাতালে আসতে হয় নানা ধরনের ব্যাধিজনিত কারণে।
রুদ্রশেখর বললেন, আমারও ঠিক একই অবস্থা। দীর্ঘদিন জেলে থেকে, বেরোবার পর দেখলাম, চারিদিকে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। যে আদর্শ, যে নীতি অনুসরণ করে আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম সে সব ভেঙে চুরমাচুর হয়ে গেছে কয়েকজন নেতার মারাত্মক ভুলের জন্য। উল্টে জনসাধারণ আমাদের দলটাকে ‘‌ক্রিমিনাল’‌ আখ্যা দিয়েছিল। জেলে থাকাকালীন বাবা–‌মা গত হয়েছেন। মৃত্যুর সময় তাঁদের পাশে থাকার সুযোগটুকুও পাইনি। এখন এক দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের কাছে বোঝা হিসেবে থেকে কোনওরকমে দিন কাটাই।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ফের বললেন, ইন্দ্রাণী, আজ তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি প্রথমেই তোমার খোঁজ করেছিলাম।
ইন্দ্রাণী বলল, থাক ওসব কথা। বৃষ্টিটা একটু কমেছে, এবার আমি বেরোব।
চলে যাওয়ার আগে হঠাৎ করে ইন্দ্রাণী রুদ্রশেখরকে প্রণাম করে বলল, যে দিন রাত্রিবেলা পুলিশের দল তোমাকে ধরে নিয়ে গেল, সেদিন ইচ্ছে থাকলেও তোমাকে প্রণাম করতে পারিনি পুলিশের অমানবিক ব্যবহারের জন্য। সেদিন পুলিশের দল আমাকেও নানা ভাবে হেনস্থা করেছিল। আজ শুধু এটুকুই বলছি, তুমি ভাল থেকো রুদ্রদা, তুমি ভাল থেকো …।
রুদ্রশেখর লক্ষ্য করলেন ইন্দ্রাণীর দু’‌চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আস্তে আস্তে ইন্দ্রাণী বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় জন–‌অরণ্যে হারিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরে পেয়ে রুদ্রশেখর উপলব্ধি করলেন, তাঁর দুটো গাল জলে ভেজা। শ্রাবণের ধারার মতো অশ্রুধারা। বহু বছর পর যেন এক মহাপ্রলয়ে একটু সময়ের জন্য জীবনটা একেবারে ওলট–‌পালট হয়ে গেল। খুবই পরিশ্রান্ত অনুভব করায় ধীরে ধীরে হাসপাতালের বড় বারান্দায় এক বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন। স্মৃতির জোয়ারে পিছিয়ে গেলেন অনেক, অনেকগুলি বছর। …………….

ছোট ঘরটায় বিভিন্ন বয়সের অনেক লোকজন। কিন্তু একেবারে চূড়ান্ত নীরবতা। শুধু বাহিরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ। ঘরটার মাঝখানে একটা ছোট মোমবাতি জ্বলছে। বলাবাহুল্য, কোনও গোপন আলোচনার জন্য এরা এখানে জড়ো হয়েছে। নিভে যাওয়া বিড়িটাকে আবার ধরিয়ে দেবেশদা উঠে দাঁড়িয়ে গুরুগম্ভীর গলায় বলা শুরু করলেন, কমরেডস, আপনাদের নতুন করে বলবার কিছু নেই। পার্টির উপর মহলের নির্দেশ অনুযায়ী বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কার কী দায়িত্ব সেটা জানাবার জন্যই আজকের এই মিটিং। আপনাদের সবাইকে প্রথমেই একটা কথা জানিয়ে রাখি, আজ আমাদের আন্দোলন শুধু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে নয় সারা ভারতবর্ষ জুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। একটা কথা সবাই মনে রাখবেন, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে আমাদের এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের সকলের দায়িত্ব, সাধারণ মানুষের মধ্যে আমাদের উদ্দেশ্য, আমাদের নীতি আর আমরা কী চাই সেটা ব্যাপকভাবে গোপনে প্রচার করতে হবে। দেশের সরকার আর পুলিশের দল আমাদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। তাই সবাইকে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করে আমাদের আদর্শের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
একটু সময় নিয়ে দেবেশদা হঠাৎ বেশ কঠিন হয়ে কাঁটা কাঁটা স্বরে বললেন, শ্রেণিশত্রুদের চিহ্ণিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে কোনওরকম দ্বিধা করবেন না। মিটিংয়ে অনেক বিষয় আলোচনার পর যখন শেষ হল, তখন রাত প্রায় গভীর।
ঘরটা ফাঁকা হতে দেবেশদা রুদ্রশেখরকে বললেন, আমাদের কাছে খবর আছে, তোমাকে ধরার জন্য পুলিশের দল হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাই পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তুমি জঙ্গলের ধারে গ্রামের এক গোপন ডেরায় তিনদিন থেকে জঙ্গলের পথ ধরে পুরুলিয়ায় আমাদের এক নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবে। সময়মতো সব খবর তোমার কাছে গোপনে পৌঁছে যাবে। গ্রামের যে গোপন আস্তানায় মানে আমাদের দলের বিশ্বস্ত কর্মী নকুলদার বাড়িতে তুমি তিনদিনের জন্য থাকবে, সেখানে যাতে গ্রামবাসীরা তোমাকে কোনওরকম সন্দেহ না করে সেই কারণে এই তিনদিনের জন্য আমাদের পার্টির নীতিতে গভীরভাবে বিশ্বাসী কমরেড ইন্দ্রাণী তোমার বউ পরিচয় দিয়ে ওখানে থাকবে। নকুলদা সবাইকে বলবে, শহর থেকে তাঁর দাদার ছেলে আর ছেলের বউ এখানে বেড়াতে এসেছে।
বৃষ্টি ভেজা কাঁচা রাস্তা ধরে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে নকুলদার কুঁড়ে ঘরে পৌঁছনো গেল। চারিদিকে গাছগাছালিতে ভরা। পিছনের দিকে ছোট ঘরে তাদের থাকার জায়গা ঠিক করা হয়েছে। নকুলদার থেকে জানতে পারল ইন্দ্রাণী কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে এসে পৌঁছবে।
ইন্দ্রাণীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর রুদ্রশেখর বেশ খানিকটা অবাকই হলেন। ইন্দ্রাণী উচ্চশিক্ষিতা আর এককথায় অপরূপ সুন্দরী। পার্টিকে ভালবেসে আর পার্টির আদর্শ, নীতিকে সমর্থন করে এই দুরূহ কাজটি করবার জন্য অনেক ঝুক্কি-ঝামেলা জেনেও এগিয়ে এসেছে। ইন্দ্রাণীর সঙ্গে পার্টি সম্পর্কিত এবং নানা বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে রুদ্রশেখর এইটুকু বুঝতে পারলেন সে তার কাজের ব্যপারে যতটাই বজ্রকঠিন, ঠিক ততটাই তার মনের আসল রূপটা কমনীয়তা, স্নেহ, ভালবাসায় ভরা এক আটপৌরে বাঙালি রমণীর মতো।

দুটোদিন বেশ সুন্দরভাবে কেটে গেল। তৃতীয় দিনের সন্ধেবেলায় যথারীতি ইন্দ্রাণী কপালে আর মাথায় সিঁধুর লাগিয়ে (দলের নির্দেশ অনুযায়ী) রুদ্রশেখরকে বলল, আজই আমাদের স্বামী–‌স্ত্রীর অভিনয় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আজ গভীর রাতে পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তুমি এখান থেকে চলে যাবে। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ আর আমতা আমতা করে বলল, রুদ্রদা, গত দুদিন বেশ সুন্দর কাটল। আমি তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে কয়েকটি কথা বলতে চাই। কিন্তু কীভাবে শুরু করব সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। আজ তুমি এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে আমি তোমাকে আমার মনের কথাগুলি জানাব।
শ্রাবণ মাস। বাহিরে অঝোরে বৃষ্টি আর মেঘের গর্জন। আচমকা একটা বিরাট বাজ পড়ার শব্দে মনে হল সারা অঞ্চলটা যেন কেঁপে উঠল। ইন্দ্রাণী ভীষণ ভয় পেয়ে নিজের অজান্তেই রুদ্রশেখরের একেবারে কাছে এসে তাঁর হাতটা জোরে চেপে ধরল। রুদ্রশেখর এই প্রথম কোনও কোমল নারী স্পর্শে সবকিছু ভুলে গিয়ে অন্তরের এক অজানা বাসনায় প্রাকৃতিক নিয়মে ইন্দ্রাণীকে আরও কাছে টেনে নিয়ে এক গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে পড়ল। কতক্ষণ এই ভাবে সুখের মুহূর্ত কাটল দুজনে কেউই টেরই পেল না। হঠাৎ দরজায় টোকা মারার শব্দে দীর্ঘ নিবিড় আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে ছলছল চোখে ইন্দ্রাণী বলল, নকুলদা হয়ত কড়া নাড়ছেন। তোমাকে একটু পরেই বেরিয়ে যেতে হবে।
দরজাটা খুলতেই পুলিশের দল হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে রুদ্রশেখরের হাত দুটো পিঠ মোড়া করে বেঁধে এক অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে বলল, শালা শয়তান, অনেক কষ্ট করে তোর সন্ধান পেয়েছি। কীসের পার্টি করিস তোরা? শোন, তোদের দলের লোকই আমাদের থেকে মোটা টাকা ঘুষ খেয়ে তোর সব খবর আমাদের জানিয়ে দিয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করছিস? নে, এবার শ্বশুরবাড়ি চল, ভাল ভাল অনেক খাবার খাওয়াবো।
বৃষ্টি ভেজা মেঠো পথ ধরে কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশের দল রুদ্রশেখরকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। ইন্দ্রাণীর দু’‌চোখ দিয়ে বৃষ্টির ধারার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অশ্রুধারা নেমে এল। মনের কথাটা মনেই রয়ে গেল। সেটা আর রুদ্রশেখরকে বলা হল না।
স্মৃতির জোয়ারে ভাসতে ভাসতে ডুবে গিয়েছিলেন অনেকটাই গভীরে। হঠাৎ হাসপাতালের ভিতরে এক কোলাহলের শব্দে ডুবে থাকা অতীত জীবনের স্মৃতি থেকে সম্বিত ফিরে পেয়ে রুদ্রশেখর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, বেলা অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। ধীর পদক্ষেপে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি ভেজা রাস্তা ধরে ঘরের দিকে এগোতে লাগলেন। একটা কথাই বারে বারে ঘুরে ফিরে মনে হচ্ছিল, তাঁর জীবনটাই ঝড়–‌জল বৃষ্টিতে ভেজা এক দিকভ্রান্ত ক্লান্ত পথিকের মতো, রৌদ্রের পরশ এ জীবনে আর হয়ত পাওয়া হল না।
‌‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.