অণুগল্প: চিহ্ন

শর্মিলা চন্দ
অর্ণবকে ওরা নিয়ে গেছে । কতক্ষণ কৃপা বলতে পারবে না। কৃপার পাশে অনেক মানুষ আছেন। কিন্তু তারা কারা! তাদের সঙ্গে কৃপার কী সম্পর্ক কৃপার কিছু মনে পড়ছে না। পাশের ঘরে একজন মহিলার বিলাপ শোনা যাচ্ছে। উনিই বা কেন বিলাপ করছেন তাও কৃপা মনে করতে পারছে না। অর্ণব চলে গেল। মুক্তি চেয়েছিল হয়ত মনে মনে। মুখে কিছুই বলেনি। কিন্তু কৃপা ঠিক বুঝতে পেরেছিল।

‘তুমি সমস্ত অফিসিয়াল কাগজে বিয়ের আগের পদবী কেন ব্যবহার কর?’ অর্ণব প্রশ্ন করেছিল কৃপাকে।
‘তাতে কী হয়েছে,অনেকেই করেন।’
‘কিন্তু অনেকে তো দুটো পদবীও ব্যবহার করেন’
‘আমি আগেরটাই করব,
‘তার মানে তুমি আমার পরিবারের অস্তিত্বই স্বীকার করো না’।
‘এটা কোনও কথাই নয় অর্ণব। তুমি কী করে এ কথা বলছো?
‘আমার মা আছেন বাড়িতে, এটা জানলে দুঃখ পাবেন’।

anu galpa
অর্ণব কিছুতেই বুঝতে চায়নি যে এই চিহ্নগুলো বহন করলেই তার পারিবারিক অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়, না হলে হয় না। শাশুড়িমাও এ ব্যাপারে মাঝে মাঝে কথা শোনাতেন।
শাশুড়ি মা! পাশের ঘরে বিলাপ করছেন উনিই বোধহয় শাশুড়িমা। কৃপার তার মুখটাও মনে পড়ছে না।

‘বউমা, তুমি সালোয়ার কামিজ পরে স্কুলে যাচ্ছো যে! এ পোশাক কিন্তু এ বাড়িতে পরা যায় না। ‘স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে কৃপা।
অর্ণবও রেডি। অফিস বেরুবে। ‘শাড়ি পরে এসো কৃপা, জানোই তো আপ রুচি খানা…
‘অসম্ভব, আমি এটা পরেই যাব, এত দূরের রাস্তা আমার সুবিধে হয়। তুমি বোঝাও মাকে। তারপর অর্ণব একসপ্তাহ তার সঙ্গে কথা বলেনি।

‘বাব্বা, হঠাৎ শাখা, সিঁদুর পরে নববধূ সাজলে যে!’
‘আমার ইচ্ছে হল,’
‘এতদিন তো পরতে না, সিঁদুরের চিহ্নও তো দেখাই যায় না, আজ এসব পরেছো অবাক হচ্ছি, মা খুশি হবেন’।
‘শোন, আমার আজ ইচ্ছে হয়েছে তাই পরলাম, কাউকে খুশি করবার জন্য নয় কিন্তু।
‘তোমাকে আমি চিনতে পারি না কৃপা, কখনও মনে হয় তুমি খুব কাছের কেউ, পরক্ষণেই দূরে সরে যাও’। অর্ণবের গলায় অভিযোগের সুর।

‘ওরা এসে গেছে বউদি, চল এবার তোমার সিঁদুর টিদুরগুলো…
একটা মেয়ে এসে বলছে কৃপাকে।
‘না আমি কোত্থাও যাবো না, আর এ সব কিছুই বদলাবো না’ কৃপা হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল মেয়েটাকে।
‘এ আবার কেমন কথা, স্বামী গত হলে কেউ এসব পরে ! ভিড়ের মধ্যে কে যেন বলল। কৃপা কিছুই শুনছে না। তাকে আরও কয়েকজন নিয়ম আচার বোঝাতে লাগলেন।
কৃপা ঠায় বসে থাকে। পাশের ঘরের মহিলা বোধহয় শুনলেন এ কথা। তার বিলাপ বেড়ে গেল।’ ওই সৃষ্টিছাড়া মেয়ে মানুষটা, যখনই সিঁদুর শাখা পরেছিল, তখনই মনটা কু ডাক ডেকেছিল, ছেলেটার আমার পরদিনই অ্যাকসিডেন্ট হল। ওকে নিয়ে যা তোরা। আমি ওকে দেখতে চাই না বিয়ের দুবছরের মধ্যেই ছেলেটা আমার……’

একে একে সবাইকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে কৃপা। আয়নার সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে নববধূর বেশে। কৃপা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখলো। তার এই বেশ কীসের চিহ্ন বহন করছে! বিবাহের, না নারীত্বের নাকি নিছকই কোনও মেয়েমানুষের। আয়নার গ্লাসে ফুটে উঠছে হাজারটা প্রশ্নোবোধক চিহ্ন। কৃপা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে কাচটা জোরে জোরে ঘষতে লাগল…

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.