রক্তিম মিত্র
দুপুর থেকেই চ্যানেলে চ্যানেলে ফের সিবিআই। তারা নাকি চার্জশিট দিয়েছে। তাতে নাকি জনৈক অভিষেক ব্যানার্জির নাম আছে।
ব্যস, আর কী চাই! বুভুক্ষু বাঙালি মেতে উঠল তাই নিয়ে। মিনিটে মিনিটে ব্রেকিং। যেন বিরাট একটা কাজ করে ফেলেছে সিবিআই। যেন বিরাট এক বিপাকে পড়েছেন সেই জনৈক অভিষেক ব্যানার্জি। যেন বিরাট এক ব্রেকিং।
যাঁরা তৃণমূল পন্থী, তাঁরা বলবেন রাজনৈতির ষড়যন্ত্র। যাঁরা বিজেপি পন্থী, তাঁরা বলছেন, সিবিআই দেখিয়ে দিল, কেউ নিস্তার পাবে না। এমনকী বামপন্থীরাও বলতে শুরু করেছেন, সিবিআইয়ের চার্জশিটেই প্রমাণ হয়ে গেল তিনিও যুক্ত।
সত্যিই কি সিবিআই উঠে পড়ে লেগেছে? সত্যিই কি এবার আসল মাথা সামনে আসবে? যাঁরা প্রবল উল্লসিত, তাঁদের একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করছে, অপেক্ষা করুন। হতাশ হতে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। পর্বতের মূষিক প্রসব দেখে যাঁরা নৃত্য করছেন, আরজি কর কাণ্ডের মতোই এক্ষেত্রেও তাঁদের হতাশ হতে হবে।
মোদ্দা কথা, সিবিআই যদি চাইত, বহু বছর আগেই এই মামলার কিনারা করতে পারত। নম নম করে চার্জশিটে নাম উল্লেখ করতে হত না। যাঁর নামে অন্তত কয়েক লক্ষ কোটির কারচুপি প্রমাণ করা যায়, তাঁর বিরুদ্ধে পনেরো কোটির গল্প শোনাতে হত না। চার্জশিটের এই দাবি আদালতে ধোপে টিকবে না। যেন না টেকে, সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে।
না, সিবিআই এর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তাঁরা চাইলে অনেককিছুই পারেন। কিন্তু দিনের শেষে তাঁরা যেটা করেন, একজন মামুলি কনস্টেবলও তার থেকে ভাল ফল দিতে পারেন। সিবিআই কেন প্রমাণ জোগাড় করতে পারে না? সিবিআই কেন তা আদালতে পেশ করতে পারে না? কেন তদন্তের শেষ হয় না? কেন মামলার ট্রায়াল বছরের পর বছর শুরুই করা যায় না? সবকিছুর উত্তর একটাই, প্রভুরা চান না, তাই।
প্রভুরা চাইলে, সাতদিনেই এই তদন্ত হয়ে যেতে পারত। যারা এক মামুলি ‘কাকু’র ভয়েস স্যাম্পল নিতে প্রায় ছয় মাস লাগিয়ে দেয়। সেই টেস্টের রিপোর্ট পেতে যাদের এক বছর লেগে যায়, কোনও ধিক্কার, কোনও ভর্ৎসনাই তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রমাণ জোগাড় করা নয়, প্রমাণ নষ্ট করাতেই যেন বেশি আগ্রহ। বছরের পর বছর সারদা তদন্ত চলে। গরু, কয়লা, বালি, নিয়োগ—সব মামলাতেই ব্যর্থ বললে কম বলা হয়। আবার বলছি, প্রভুরা চান বলেই তদন্ত বারবার শীতঘুমে চলে যায়।
সেই প্রভুরা হঠাৎ উল্টো চাইতে শুরু করবেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। যাঁরা তিনশোর ওপর আসন নিয়ে কিছু করতে পারেননি, এখন আড়াইশোর নিতে। নীতিশ, চন্দ্রবাবু— এই দুটো ক্রাচ বাইরে থেকে দেখা যায়। বাজেটের ছত্রে ছত্রে বোঝা যায়। কিন্তু আরও কিছু অদৃশ্য ক্রাচ আছে। আরও কিছু অদৃশ্য বন্ধুকেও যে দরকার। তাছাড়া, বিরোধী শিবিরকে ঘেঁটে দেওয়ার জন্যও কাউকে কাউকে খুব দরকার। তাঁদের টিকিয়ে রাখতেই হবে।
তাহলে এই চার্জশিট! হুজুর, আমরা একেবারে ঘুমিয়ে নেই, এটুকু বোঝানোর জন্য যেটুকু দরকার, সেটুকুই। কাকু জানতেন, সাহেবের কিছু হবে না। তাই জোর গলায় বলতেন, আমার সাহেবকে কেউ ছুঁতে পারবে না। সাহেব জানেন, তাঁর কিছুই হবে না। তাই তিনি প্রকাশ্যে বলতে পারেন, সিবিআই, ইডি আমার কাঁচকলা করবে।
আবার প্রমাণিত হবে, তাঁরাই ঠিক বলেছেন। আবার প্রমাণিত হবে, সিবিআই আসলে ছড়িয়ে লাট করেছে। তাঁদের বাঁচানোর লোকেরা যতদিন থাকবেন, সিবিআই সত্যিই কিছু করে উঠতে পারবে না। চার্জশিটে দু চার লাইনের ফুটনোট দেওয়া হবে। বড়জোর টিভি চ্যানেলকে আলোচনার একটু খোরাক দেওয়া হবে। এর বেশি সিবিআইয়ের কিছুই করার নেই। অন্তত গত দশ বছরে তাদের যা ধারাবাহিকতা, তাতে কোনও প্রত্যাশা না রাখাই ভাল।