সৃজন শীল
একেকজনের ভালবাসার ক্ষেত্র একেকরকম। যিনি রাজনীতি ভালবাসেন, তিনি সবকিছুকে রাজনীতির মোড়কে দেখতে চান। যিনি খেলা ভালবাসেন, তিনি টিভি বা ইউটিউবে খেলার ভিডিওই বেশি করে দেখেন। যিনি গানবাজনা ভালবাসেন, তিনি সঙ্গীতশিল্পীদের কথাই শুনতে চান।
ঠিক তেমনই, আমি একজন শিক্ষক। ছোট থেকেই সাহিত্য মনষ্ক। তাই আমার দিনের একটা বড় অংশ সাহিত্যের আঙিনাতেই কাটে। আমার কাছে বাংলাদেশ মানে শেখ হাসিনা বা মহম্মদ ইউনূসের দেশ নয়। আমার কাছে বাংলাদেশ হল শামসুর রহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহাদের দেশ। আমার কাছে বাংলাদেশ হল আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আহমেদের দেশ।
একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। স্মার্টফোন আসার পর খুব ইচ্ছে হত, ইন্টারনেটে বিভিন্ন সাহিত্যিকদের ইন্টারভিউ শুনব। এপার বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যিকদের নাম ধরে সার্চ মারতাম। বেশিরভাগ লিঙ্ক আসত বাংলাদেশের। অর্থাৎ, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়দের মতো দিকপাল সাহিত্যিকরা যখন বাংলাদেশে গেছেন, সেখানকার কোনও প্রথমসারির চ্যানেল তাঁদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছে। প্রাইম টাইমে খুব গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো প্রচার করেছে।
ছবিটা যে এখনও খুব বদলেছে, এমন নয়। মনে করে দেখুন তো, আমাদের রাজ্যের যেগুলো মূলস্রোত চ্যানেল, সেখানে এইসব দিকপাল মানুষদের সাক্ষাৎকার কবার দেখেছেন? কেউ মারা গেলে, ফোনে ধরে কয়েক লাইনের প্রতিক্রিয়া। কোনও একটা বিষয় নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, তখন হয়তো কোনও সাহিত্যিকের দু–চার লাইন বাইট। ভাগ্যিস, সাহিত্যমনষ্ক কিছু ইউটিউব চ্যানেল আছে। যাঁরা সীমিত সামর্থ্য নিয়েও সাহিত্যের, সাহিত্যিকদের কথা তুলে ধরছে। কিন্তু মূলস্রোত মিডিয়া! আমাদের বরেণ্য সাহিত্যিকদের আমরা কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছি? কিন্তু বাংলাদেশের আমজনতা তাঁদের মাথায় করে রেখেছে। আমাদের সাহিত্যিকদের যে শ্রদ্ধার চোখে সেই দেশে দেখা হয়, আমরা কি আদৌ ওপার বাংলার সাহিত্যিকদের সেই শ্রদ্ধার চোখে দেখি? ওপার বাংলার মানুষ যতখানি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা সমরেশ মজুমদারের লেখা পড়েছেন, এপার বাংলার মানুষ কি ততখানি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা হুমায়ুন আহমেদকে পড়েছেন? সে দেশের কোনও সাহিত্যিক এ দেশে এলে, আমাদের মূলস্রোত চ্যানেলে কি তাঁর ইন্টারভিউ রেকর্ড করা হয়েছে? ও দেশের কথা ছেড়েই দিলাম, আমরা নিজেদের সাহিত্যিকদেরই মূল্য দিই না। প্রাইম টাইমে কোনও সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার দেখানো হচ্ছে, এমনটা ভাবতেই পারি না। এখনও যে কোনও সাহিত্যিকের নাম ধরে সার্চ করুন। বাংলাদেশের লিঙ্কই বেশি পাবেন।
আচ্ছা, সে দেশের চ্যানেলে আমাদের সাহিত্যিককে এত গুরুত্ব দেওয়া হয় কেন? কারণ, সে দেশের দর্শক তাই চান। ও দেশের মানুষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা সমরেশ মজুমদারের একটা ইন্টারভিউ দেখার সুযোগ পেলে অন্য সব হাতছানিকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। এই কারণেই সে দেশের প্রথমসারির চ্যানেলগুলিও আমাদের সাহিত্যিকদের এই সম্মান দেখিয়ে থাকে।
অথচ, নাম কে ওয়াস্তে কয়েকটা লোকের ফেসবুক পোস্ট দেখে আমরা কী অবলীলায় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলাম যে, বাংলাদেশের লোকেরা ভারতকে সহ্য করতে পারে না। একশ্রেণির বিকৃত মনের উন্মাদ সব দেশেই থাকে। তাঁদের সেই হুঙ্কারকে আমরা সেই দেশের আমজনতার কণ্ঠস্বর হিসেবে ধরে নিচ্ছি। এ যে আমাদের কতবড় অজ্ঞতা, তা আমরা বুঝতেও পারছি না। দুই দেশের সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যকে কেমন বিষিয়ে চলেছি। এই সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের আবহ নির্মাণ হতে বছরের পর বছর লেগেছে। কিন্তু তাকে নষ্ট করতে আমরা কত মরিয়া! আমাদের চ্যানেলগুলি নাকি দেশকে দারুণ ভালবাসে। তাহলে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের সাক্ষাৎকার খুঁজতে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখতে হয় কেন?