অজয় কুমার
চিকিৎসকদের আন্দোলন কি গণ আন্দোলনের চেহারা নিয়েছে? গ্রামের মানুষের মধ্যে কি এর কোনও প্রভাব পড়েছে? মাঝে মাঝেই এমন প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে। ধরা যাক, এখনও এটা গণ আন্দোলন হয়নি। ধরেই নিলাম, এখনও গ্রামাঞ্চলে সেভাবে প্রভাব পড়েনি। কিন্তু তারপরেও বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনার জীবনে এমন আন্দোলন আপনি দেখেছেন? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এই নিষ্ঠা দেখানো যায়!
আমাদের দেশে বা আমাদের রাজ্যে কোনও আন্দোলন শুরু হয় ঠিকই, কিন্তু দ্রুত তা কোনও না কোনও রাজনৈতিক দল হাইজ্যাক করে নেয়। কদিন যেতে না যেতেই রাজনীতির লোকেরা এসে পড়েন। তাঁদের কথাতেই আন্দোলন পরিচালিত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমনটা হচ্ছে না। এঁরা যথেষ্ট বিচক্ষণ। নিজেরাই নিজেদের চালিকাশক্তি। কারও কথায় ওঠা–বসা করার বান্দা অন্তত এঁরা নন।
কিন্তু তারপরেও কয়েকটা প্রশ্ন থেকে যায়। যেভাবে পাশে থাকা মানুষদের ‘গো ব্যাক’ বলা হচ্ছে, তা কোথাও যেন অসহিষ্ণুতার মাত্রাকে আরও প্রকট করছে। কখনও অপর্ণা সেনকে গো ব্যাক বলা হচ্ছে, তো কখনও প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলিকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতি কি এড়ানো যেত না? তাঁদের মঞ্চে তাঁরা কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তির উপস্থিতি চাইছেন না, বেশ ভাল কথা। কিন্তু গেলেই তাড়িয়ে দিতে হবে কেন? যাঁরা আন্দোলনে সহমর্মিতা জানাতে গেছেন, তাঁদের তো ভদ্রভাবেও বলা যায়। যেমন অভিজিৎ গাঙ্গুলির কথাই ধরা যাক। হতেই পারে, তিনি বিজেপির সাংসদ। প্রত্যক্ষ রাজনীতির লোক বলা যেতেই পারে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইকেও উপেক্ষা করার নয়। তিনি না থাকলে শিক্ষা দুর্নীতি নিয়ে যেটুকু ব্যবস্থা হয়েছে, যেটুকু মানুষের সামনে এসেছে, সেটুকুও হত না। অন্তত তাঁর সেই সত্তাকে তো সম্মান জানানো যেত। তাঁকে মঞ্চে তোলার দরকার নেই। কিন্তু বিনীতভাবে তো বলা যেত, স্যর, আমাদের মঞ্চে রাজনীতির লোকেরা আসুক, আমাদের আন্দোলনে রাজনীতির রঙ লাগুক, আমরা চাই না। আশা করি, আপনি আমাদের অবস্থানকে সম্মান জানাবেন। এটুকু ভদ্রভাবে বললে তিনি নিজেই সেখান থেকে চলে যেতেন। তার বদলে ‘গো ব্যাক’ ধ্বনি তুলে কার্যত তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হল।
এটা যদি তৃণমূলের কোনও পাড়ার নেতা করতেন, কিছু বলার ছিল না। তাঁদের কাছে সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু প্রতিবাদী চিকিৎসকরা এত অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছেন কেন? নিজেদের তৃণমূলের স্তরে নামিয়ে আনছেন কেন? এতে কার হাত শক্তিশালী হচ্ছে? মনে রাখবেন, শঙ্কুদেব পন্ডা আর অভিজিৎ গাঙ্গুলি এক নন। এই ফারাকটা বোঝাও খুব জরুরি। এতজন চিকিৎসক একসঙ্গে আন্দোলন করলে নানা মত উঠে আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। আন্দোলনের পন্থা নিয়ে বিতর্ক থাকবে, সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু কতগুলো ব্যাপারে ন্যূনতম ঐক্যমতটাও জরুরি। আমাদের আন্দোলনে সহমর্মিতা জানাতে এলে আমরা কাউকে কুকুর–ছাগলের মতো তাড়াব না, অন্তত এই ব্যাপারে একমত হওয়াই যায়। অন্য জগতের যাঁরা আসবেন, তাঁদের জন্য দূরে আলাদা কোনও মঞ্চ করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখতে পারেন। দরকার হলে চিকিৎসকদের কয়েকজন প্রতিনিধি সেখানে দেখা করে আসবেন, কথা বলে আসবেন।
এই আন্দোলনের দিকে সারা রাজ্য তাকিয়ে। সারা দেশ তাকিয়ে। সেই কারণেই দায় অনেক বেশি। সামান্য হঠকারিতা ভুল বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। প্রতিবাদের দৃঢ়তা যেমন থাকবে, শিক্ষা ও শিষ্টাচারও থাকবে। বাইরে থেকে এমন জ্ঞান দেওয়াটা হয়তো খুব সোজা। কিন্তু যাঁরা রোদে, জলে আন্দোলন করছেন, তাঁরা সবসময় ব্যকরণ মেনে চলবেন, এমন প্রত্যাশা করাটাও হয়তো একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই ছেলে–মেয়ে গুলোকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশাও যে বাড়ছে। এঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে পরের প্রজন্ম। তাই আরেকটু সহিষ্ণুতার অনুশীলনটাও জরুরি।