সরল বিশ্বাস
(শিরোনামটা দেখে মনে হতে পারে, নির্ঘাত কোনও তৃণমূলি এই লেখাটা লিখছে। নির্ঘাত বলতে চাইছে, সিবিআই নির্দোষ লোকেদের ধরে হেনস্থা করছে, বাংলার সরকারকে বদনাম করতে চাইছে। লেখাটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হলে, শুধু শিরোনাম দেখেই কমেন্ট বক্স গালমন্দে ভরে যেত। সত্যিই তো, এত পড়ার ধৈর্য কোথায়? ‘চটিচাটা’ ‘তৃণমূলের দালাল’ এই শব্দগুলো তো মুখস্থই আছে। লিখে দিলেই হল। আসলে, এই লেখার শিরোনাম দেখে যা মনে হচ্ছে, ভেতরটা পড়লে উল্টোটাই মনে হবে। যদি ধৈর্য থাকে, পড়তে পারেন। )
একে একে সবাই জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। কখনও জামিন পাচ্ছেন বাকিবু , কখনও শঙ্কর আঢ্য। শিক্ষা দুর্নীতি মামলায় জামিন পাচ্ছেন মানিক ভট্টাচার্য। গরু পাচার মামলায় প্রথমে সুকন্যা, পরে অনুব্রত মণ্ডল।
সিবিআই কোন পথে চলেছে আবার দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অনেকে বলতেই পারেন, আদালত জামিন দিয়েছে। কিন্তু আদালত কেন জামিন দিল? জামিন দেওয়ার সময় আদালত লিখিত অর্ডারে জানাচ্ছে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। আর সেটাকে ঢাল করেই অভিযুক্তরাও বাইরে এসে দিব্যি বিজয়ের উল্লাস করছেন। সেই চিরাচরিত সংলাপ, ‘প্রমাণ হয়ে গেল আমি নির্দোষ।’ জামিন পাওয়া মানেই যে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া নয়, সেটা এই অর্বাচীনদের কে বোঝাবে! আসলে, তাঁরাও জানেন বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে ঢের দেরিতে, আর এই বিচারের ফল কতদিনে বেরোবে তা কেউ জানে না। অর্থাৎ একবার ছাড়া পেয়ে যাওয়া মানে, চিরতরেই ছাড়া পেয়ে যাওয়া।
মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তদন্ত চলছে। সিবিআই কখনও এক হাজার পাতার, কখনও দেড় হাজার পাতার রিপোর্ট জমা করছে। তারপরও আদালত বলছে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। এই যদি তদন্তের নমুনা হয়, এই যদি বিচার ব্যবস্থার নমুনা হয়, তাহলে এই দুই স্তম্ভের ওপর ভরসা রাখা সত্যিই কঠিন। অনেকেই বলেন আদালতের ওপর আস্থা আছে। কেন বলেন জানি না। কিছু হলেই অনেকে বলেন, সিবিআই তদন্ত চাই। কেন বলেন, তাও জানি না। আচ্ছা বলুন তো, সিবিআই এর ওপর ভরসা রাখার কোনও কারণ আছে? গত দশ বছরে সিবিআই এমন একটি কাজও করেছে যে তাদের ওপর ভরসা রাখা যাবে? হম্বি তম্বি করে তদন্ত নেমে বড়জোর গোটা কয়েক চুনোপুটিকে গ্রেপ্তার করেছে। তারপর আপন নিয়মে তারা ছাড়াও পেয়ে গেছে। মাথা পর্যন্ত তো দূরের কথা, কোমর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। তাদের দৌড় ওই হাঁটু পর্যন্তই।
এরপরেও আদালতের দ্বারস্থ হয়ে কেন আমরা সিবিআই চাই? সিপিআই অফিসারদের দক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। সত্যিই তাঁরা চাইলে সাত দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারেন। যখনই তাঁরা অনন্ত সময় চান, তখনই বুঝতে হয় এটা ঠান্ডা করে চলে গেল। এই তদন্ত নিশ্চিতভাবেই ধামাচাপা পড়ে গেল। শুধু কয়েকজন সিবিআই কর্তা ইচ্ছে করে গড়িমসি করছেন এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। জমিদার ১০০ টাকা তুলতে বললে নায়েব মশাই দুশো টাকা তুলবে। দিল্লির কর্তারা শীত ঘুমে যেতে বললে সিবিআই শীত ঘুমেই যাবে। মাঝে মাঝে জেগে উঠতে বললে তারা হঠাৎ করে জেগে উঠবে। যাঁরা দিনের পর দিন, বছরের পথ বছর সিবিআইকে এভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখছেন, প্রশ্ন করতে হলে তাঁদের করুন।
সারদাই বলুন আর নারদায় বলুন, শিক্ষা দুর্নীতি বলুন আর গরু পাচারই বলুন, প্রতিটি মামলার তদন্তে নেমে সিবিআই চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কখনো কখনও মনে হয়, তাঁরা বুঝি প্রমাণ লোপাট করতেই নেমেছেন। অনেক আগে একেবারে সঠিক জায়গায় আলো ফেলেছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি। আদালতের বসে যথেষ্ট ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে আপনারা প্রমাণ লোপাট করে অপরাধীদের আড়াল করতে চাইছেন। তখন হয়তো একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, তত পরিষ্কার হচ্ছে সেই পর্যবেক্ষণ কতটা সঠিক ছিল।
কোনও এক দুর্বৃত্ত যখন ৯ ঘন্টা জেরার পর বাইরে বেরিয়ে এসে দেড় ঘণ্টা প্রেস কনফারেন্স করেন এবং চ্যালেঞ্জ করে বলেন আমার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ দেখিয়ে দিক, তখন সেই দুর্বৃত্তের ওপর আর রাগ হয় না। বরং মনে হয় যাঁরা এতক্ষণ জেরা করলেন, তাঁদের ওপর। মনে হয়, এই দুর্বৃত্তের বিচার পরে হবে। আগে এই অফিসারদের ফাটকে ঢোকানো দরকার। আগে তাঁদের সাসপেন্ড করা দরকার। এই দুর্বৃত্তরা বেরিয়ে আসার পরেই এমন হুঙ্কার ছাড়ার সাহস পায় কোত্থেকে? সাহস পায়, কারণ তারা জানে এই সিরিআই কিচ্ছু করতে পারবে না। সাহস পায়, কারণ তারা জানে তাদের তাদের আসল রক্ষাকর্তা দিল্লিতে রয়েছেন। এই সহজ সত্যিটা যাঁরা বোঝেন না, তাঁরা হলেন বঙ্গ বিজেপি।
তাই মমতা আর পদত্যাগ চাইবার আগে বুঝতে শিখুন মমতা কার বলে বলিয়ান। বুঝতে শিখুন কার বা কাদের নির্দেশে সিবিআই দিনের পর দিন ঘুমিয়ে থাকে। আগে তাকে ঘৃণা করতে শিখুন।