সিঙ্গুর এখন আবির খেলুক। মিস্টিমুখ করুক। বিজয়োৎসব করুক। একদিন তাঁরা ঠিক বুঝতে পারবেন, কে তাঁদের আসল বন্ধু ছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে খোলা চিঠি। লিখলেন স্বরূপ গোস্বামী।।
মাত্র একদিনেই ছবিটা যেন পাল্টে গেল। সবার সুর যেন বদলে গেল। টাটার চলে যাওয়া মারাত্মক ক্ষতি, এমনটা যাঁরা মনে করতেন, তাঁদের অনেকেই এখন বলতে শুরু করেছেন, জমি নেওয়া অন্যায় হয়েছিল। শুধু মমতার প্রশস্তিতেই থেমে থাকছে না। নোংরা ও কদর্য আক্রমণ চালানো হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে।
সোশাল সাইটে কী কদর্য ভাষা। আপনার ছবির পাশে গ্রাফিক্স করে লেখা হচ্ছে, ঘুষখোর, জমির দালাল। নিখাদ তৃণমূলিরা লিখলে তবু না হয় কথা ছিল। একসময় আপনার দপ্তরের সরকারি আমলাকেও দেখলাম বিকৃত উল্লাসে এমন ছবি প্রচার করতে।
টাটার কারখানা বাংলায় আনতে এত উদগ্রীব কেন ছিলেন ? আপনার কোনও ‘জমির হাঙর’ ভাই আছে ? তাঁদের প্রোমোটিং ব্যবসা আছে? আপনার কোনও ভাইপো আছে ? কারখানা হলে তাঁর ‘বাণিজ্যে’ সুবিধা হত?
চেয়েছিলেন, শিল্পের মানচিত্রে রাজ্যকে আরও তুলে ধরতে। চেয়েছিলেন, লক্ষ লক্ষ বেকার ছেলেদের কর্মসংস্থান হোক । হয়ত একটু তাড়াহুড়ো ছিল। হয়ত পদ্ধতিগত ত্রুটিও ছিল। কিন্তু আজও গভীরভাবে বিশ্বাস করি, সদিচ্ছায় কোনও ঘাটতি ছিল না।
বিরোধী নেত্রী যখন অনশনে, আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে চারবার চিঠি দিয়েছেন। রাজ্যপালের মধ্যস্থতায় যে আলোচনা হল, তা মেনেই নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও জটিলতা পাকানো হল। যেনতেন প্রকারেণ কারখানা বানচাল করতে হবে। টাটাকে তাড়াতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে অনেকটাই সফল তখনকার বিরোধী নেত্রী।
আমাদের রাজ্যটা বড়ই অদ্ভুত। এখানে বিধানসভা ভাঙচুর বৈধতা পেয়ে যায়। রাজ্য সড়ক দিনের পর দিন আটকে রাখা বৈধতা পেয়ে যায়। টাটাকে তাড়িয়ে দেওয়া সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়। কারখানা বা চাকরির বদলে দু-টাকার চালেই মানুষ খুশি হয়ে যায়।
এমন একটা রাজ্যকে আপনি নতুন স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছিলেন ? মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনারা চলে গিয়ে ভালই হয়েছে। আমাদের যেমন সরকার প্রাপ্য, যেমন মুখ্যমন্ত্রী প্রাপ্য, আমরা তেমনটাই পেয়েছি। আমাদের কোনও যোগ্যতাই নেই আপনার মতো সুস্থ রুচির, সৎ ও আপাদমস্তক ভদ্রলোক এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার।
২১১ আসন পাওয়ার পরেও যারা একের পর এক জেলা পরিষদ, পুরসভা দখলে উন্মত্ত, তাদের প্রতি আমাদের চোখেমুখে কোনও ঘৃণা নেই। বরং, এই ডাকাতি-কে বীরত্ব হিসেবেই দেখতে শিখেছি। অথবা, দৈনন্দিন উদাসীনতায় দিব্যি মেনে নিয়েছি।
কোর্টের রায়ের পর সব সুর যেন পাল্টে গেল। কাল পর্যন্ত যারা বলছিল, টাটা চলে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে, তারাও কেমন যেন উল্টে গেল। তাদের চোখেও আপনি যেন খলনায়ক। সিঙ্গুরে আবির খেলা চলছে। শুক্রবার সারা রাজ্যে বিজয় উৎসবও হবে। সিঙ্গুরের চাষী হয়ত জমি ফিরে পাবেন। কিন্তু সারা সিঙ্গুর কী হারাল, সারা রাজ্য কী হারাল, সেই অশনি সংকেত কি কেউ টের পাচ্ছেন ?
বুদ্ধদেববাবু, ভেঙে পড়বেন না। মন খারাপ করবেন না। নোংরা আক্রমণের শিকার আগেও হয়েছেন। হয়ত আবার হতে হবে। আজ সিঙ্গুরের মানুষ আবির খেলছেন। মিস্টিমুখ করছেন। দু টাকার চালও পাবেন। হয়ত আরও কিছু দাক্ষিণ্য পাবেন।
কিন্তু তাঁরা কী হারালেন, একদিন ঠিক বুঝবেন। তাঁদেরও পরবর্তী প্রজন্ম হয়ত বুঝবে, কে তাঁদের আসল বন্ধু ছিল।