দলবদলুদের অর্ধচন্দ্র চাই

ধীমান সাহা

একদলের টিকিটে জিতলেন। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতে অন্য দলে চলে গেলেন। আমাদের রাজ্যে এমন সংস্কৃতি ছিল না। কিন্তু এখন এটা হামেশাই ঘটছে। সকালেও তিনি হয়তো বিজেপিতে ছিলেন। বিকেলে দেখা গেল, তাঁর হাতে তৃণমূলের পতাকা। আবার উল্টোটাও আছে। এত বছর তিনি তৃণমূল করেছেন। টিকিট না পেতেই দেখা গেল, দম বন্ধ হয়ে আসছে। মমতা ব্যানার্জির ছবি বাড়ি থেকে নামিয়ে টাঙিয়ে দিলেন নরেন্দ্র মোদির ছবি। হঠাৎই মনে হল, তৃণমূলের থেকে খারাপ দল হয় না। মোদির মতো বিকাশ পুরুষ এই দেশের ইতিহাসে আর আসেনি।

চলতি ভাষায় এঁদের বলা হয় ‘‌দলবদলু’‌। এবারের ভোটেও এই দলবদলুদের বেশ রমরমা। একটা দলের সঙ্গে একজন নেতা বা কর্মীর দূরত্ব বাড়তেই পারে। নানা মান অভিমানের পর্ব চলতেই পারে। একটা সময় এসে মনে হতেই পারে, সম্মান নিয়ে এই দলটা আর করা যায় না। যেমন তাপস রায়। অনেকদিন ধরেই দলের সঙ্গে দূরত্ব একটু একটু করে বাড়ছিল। মনে হতেই পারে, যোগ্যতা অনুযায়ী স্বীকৃতি পাননি। এবং, এটা ঘটনা, ক্যাবিনেটে যেসব কীর্তিমানরা আছেন, তাঁদের তুলনায় তাপস রায়ের অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, স্বচ্ছতা অনেক বেশি। তিনি দল ছাড়বেন, মোটামুটি বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু আগে বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন। তারপর অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। অন্তত নৈতিকতার কিছুটা নিদর্শন রেখেছেন। তবে যুক্তিটা বড় অদ্ভুত। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি মোদির বিরোধিতা করেন না, গোপনে বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেন। সেই প্রতিবাদে তাপস রায় কিনা বিজেপি হয়ে গেলেন।

যাই হোক, এবার অন্য কীর্তিমানদের কথায় আসি। এবার ব্রিগেডের ওই প্রার্থীদের র‌্যাম্প শোয়ে এমন অনেকেই তৃণমূলের হয়ে হেঁটেছেন, যাঁরা খাতায় কলমে বিজেপির বিধায়ক। যেমন রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণী। বিধানসভায় জিতলেন বিজেপির হয়ে। বছর দুই যেতে না যেতেই মনে হল, বিজেপি বিধায়ক হয়ে এলাকায় কল্কে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ কথা শুনছে না। অমনি মনে হল, শাসক দলে গেলে কেমন হয়!‌ চলে গেলেন। পেয়ে গেলেন পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যানের পদ। বিধানসভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা পদ। সরকারের আয়–‌ব্যয়ের হিসেব খতিয়ে দেখার কমিটি। সরকারকে ভুলত্রুটি শুধরে নতুন দিশা দেখানোর এক কমিটি। যার চেয়ারম্যান বিরোধীদের ভেতর থেকেই করতে হয়। মাননীয় স্পিকারের কল্যাণে এই পদটি এখন দলবদলুদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। যাই হোক, বিজেপি বিধায়ক থাকতে থাকতেই তিনি তৃণমূলের র‌্যাম্পে হাঁটা শুরু করে দিলেন। দেওয়াল লিখতে শুরু করে দিলেন। সভা করাও শুরু করে দিলেন। তারপর মনোনয়নের আগে নেহাত পদত্যাগ না করলেই নয়। নইলে মনোনয়ন খারিজ হয়ে যাবে। কী আশ্চর্য, সেই পদত্যাগকে নৈতিকতার নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হল!‌

বনগাঁর বিশ্বজিৎ দাস। একসময় তৃণমূলের বিধায়ক ছিলেন। এসএসসি ও টেট কেলেঙ্কারিতে সবথেকে বেশি করে যাঁর নাম সামনে এসেছিল, তিনি এই বিশ্বজিৎ। পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন মিলে কতজনের নাম যে ভুয়ো তালিকায় ঢুকেছিল, তার কোনও হিসেব নেই। তারপরেও তিনিই ছিলেন তৃণমূলের রত্ন। ২০২১ এর আগে মনে হল হাওয়া গন্ডগোল। অমনি ঝাঁপ মারলেন বিজেপিতে। আর বিজেপির দরজাও খোলাই ছিল। জামাই আদরে বরণ হয়ে গেল। টিকিট পেলেন। জিতেও গেলেন। কিন্তু হায়!‌ ভেবেছিলেন, বিজেপির সরকার হবে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হবেন। কিন্তু বিরোধী বিধায়ক হয়ে কাঁহাতক আর থাকা যায়!‌ পুলিশ কী কী কেস দিতে পারে, কীভাবে হেনস্থা করতে পারে, টেট–‌বিশ্বজিতের বেশ ধারণা আছে। অতএব, পুণঃমূষিক ভব। ফিরে এলেন সেই চেনা ঠিকানায়। এক্ষেত্রেও স্পিকার মশাই বছরের পর বছর নীরব রইলেন। ওঁদের হয়ে স্পিকার মশাই–‌ই সওয়াল করে গেলেন, ‘‌ওঁরা তো বিজেপিতেই আছেন।’‌ আসলে, এরকম স্পিকার থাকলে দলবদলুদের সত্যিই পোয়াবারো। তাঁরা জানেন, দলবদল করলেও সদস্যপদ খারিজ হবে না। কারণ, স্পিকার হিসেবে এমন একজন মানুষ বসে আছেন, যিনি আজ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে পারেননি। স্পিকারের প্রতি, তাঁর মহান নিষ্ক্রিয়তার প্রতি দলবদলুদের ‘‌অগাধ আস্থা’‌।

এবার ভোটের একেবারে প্রাক লগ্নে। মুকুটমণি অধিকারী। আগেরবারই লোকসভায় বিজেপির তালিকায় তাঁর নাম ছিল। কিন্তু তখন তিনি ছিলেন সরকারি চিকিৎসক। ভোটে দাঁড়াতে গেলে পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু নানা টালবাহানায় তাঁর পদত্যাগ গৃহীত হল না। আর দাঁড়ানো হল না। নেপোয় দই মারার মতো জগন্নাথ সরকার রানাঘাটের এমপি হয়ে গেলেন। মুকুটমণিকে ২০২১ –‌এ জিতে বিধায়ক হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল। এবার ভেবেছিলেন, লোকসভার তালিকায় তাঁর নাম থাকবে। কিন্তু এবারও জগন্নাথেই ভরসা রাখল বিজেপি। অতএব, তিনি ধরে নিলেন তৃণমূলের পতাকা। দুদিন আগেই মোদির সভায় হাজির হয়েছেন। রামমন্দির থেকে সিএএ— বিজেপির একের পর এক এজেন্ডায় জোরদার প্রচার করেছেন। দুদিন পরই ঘুরে গেলেন একশো আশি ডিগ্রি। তখন তাঁর কাছে এনআরসি খারাপ, সিএএ খারাপ, রামমন্দির খারাপ, মোদি খারাপ। আর যেগুলো খারাপ ছিল, সেগুলো রাতারাতি ভাল হয়ে গেল।

হ্যাঁ, এই তিন দলবদলু এবার লোকসভার প্রার্থী। যাঁরা প্রার্থী ঘোষণার সময়েও বিজেপির বিধায়ক। এমনকী ঘোষণার পরদিন পদত্যাগ করলেও না হয় বোঝা যেত, কিছুটা নৈতিকতা আছে। অপেক্ষা করেছেন মনোনয়ন পর্যন্ত। এই তালিকায় ‘‌দলবদলু’‌ আরও অনেকে আছেন। কিন্তু তাঁরা আগেই এসেছেন। তাছাড়া, তাঁরা একদলের টিকিটে জিতে অন্য দলে আসেননি। আসলে, এই রাজ্যে দলবদল যেভাবে স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে কোথাও একটা লাগাম টানা দরকার। কে এই লাগাম টানবে?‌ স্পিকার মশাই যথার্থই ঠুঁটো জগন্নাথ। অন্য দলে কেউ গেলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ‘‌গদ্দার’‌ বলেন ঠিকই, কিন্তু অন্য দলের নির্বাচিত বিধায়ক বা সাংসদ তাঁর দলে এলে দরজা খুলে দেন। তাছাড়া, তাঁর হাত ধরে আয়ারাম–‌গয়ারামদের এই রমরমা। আর বিজেপি!‌ দল ভাঙানোর ব্যাপারে তাদের সুনামও কম নেই। তাঁরাও এইসব উচ্ছিষ্টদের জন্য দরজা খোলাই রেখেছেন। যেমন, অর্জুন সিং। ২০১৯–‌এ তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে এলেন বিজেপিতে। জিতে গেলেন। পরে মনে হল, তৃণমূলে যোগ দেওয়া দরকার। পদত্যাগ না করেই পতাকা ধরে নিলেন। এবার তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে ফের বিজেপিতে। কী আশ্চর্য, বিজেপিও দরজা খুলে দিল। আবার তাঁকেই টিকিট দিল। তিনিই টিকিট পাচ্ছেন, তিনিও কি পরম নিশ্চিন্তে রইলেন! কাঁথির শিশির অধিকারী বা তমলুকের দিব্যেন্দু অধিকারী। তাঁরা যে আর তৃণমূলে নেই, এটা দুনিয়াসুদ্ধু সবাই জানত। তারপরেও তিন বছর পদ ধরে রাখলেন। এতে শিশিরবাবুর রাজনৈতিক উচ্চতা কিছুটা তো খাটো হল। পদত্যাগ করলে আরও সম্মানের সঙ্গে এই নামটা উচ্চারিত হত। শুভেন্দুও আরও কিছুটা মাথা উঁচু করে লড়াই করতে পারতেন। ‌

অতএব, ভরসা সেই জনতাই। দলবদলে রাশ টানার একটাই উপায়, এই দলবদলুদের বুঝিয়ে দেওয়া যে, জনতার সমর্থন নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলা চলবে না। ভোটারদের সমর্থনকে বিক্রি করার বিরুদ্ধে ভোটাররাই পারেন গর্জে উঠতে। যাঁরা যেখানে জিতছেন, জিতুন। কিন্তু এই দলবদলুদের সংসদে দেখতে চাই না।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.