ভি ফর ভিক্টর

স্বরূপ গোস্বামী

সময়টা ২০০৯ এর শেষদিক। এই রাজ্যে তখন পরিবর্তনের ঝড়। রাজ্যে একসঙ্গে দশটি আসনে বিধানসভার উপনির্বাচন। নটিতেই হারতে হয়েছিল বামেদের। জিতেছিল শুধু একটি আসনে, গোয়ালপোখর। অথচ, সেই আসনে ছমাস আগেই বামেরা পিছিয়েছিল ২৭ হাজার ভোটে। সেই কঠিন সময়ে যিনি মিরাক্যাল ঘটিয়েছিলেন, তিনি আলি ইমরান।

রাজ্য রাজনীতিতে যেন লেখা হল নতুন এক ইতিহাস। বিধানসভার কনিষ্ঠতম সদস্য। বাংলাটা তখনও তেমন গুছিয়ে বলতে পারেন না। কিন্তু হিন্দি আর উর্দুতে ঝড় তুলতে লাগলেন বিধানসভায়। ২০১১। একে একে পরাজিত রথী মহারথীরা। কিন্তু চরম প্রতিকূলতার মাঝেও মার্জিন প্রায় ডাবল করে ফিরে এল সেই তরুণ মুখটা। এবার বিধানসভা চিনল অন্য এক ইমরানকে। তাঁর ডাক নাম যে ভিক্টর, ততদিনে সেটা বেশ ছড়িয়েও গেছে। পোশাকি ইমরান নামটাকে ছাপিয়ে ভিক্টর নামটাই যেন হয়ে উঠল ঝড়রে এক প্রতিশব্দ। সেবারও তিনি তরুণতম। কিন্তু একা তাঁর আক্রমণেই যেন নাজেহাল তামাম শাসককূল।

তখন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে প্রশ্ন করা হল, আপনাদের নতুন মুখ তো সেভাবে উঠে আসছে না!‌ সূর্যবাবু বরাবরই অল্প কথার মানুষ। বিশেষ কাউকে ঘিরে খুব একটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায় না। বেশ মনে আছে, সেদিন বিশেষ একজনের নাম তুলে ধরেছিলেন। সেই নামটি হল ভিক্টর। সূর্যবাবু বলেছিলেন, ‘‌এই ছেলেটি আমার দলের নয়, ফরওয়ার্ড ব্লকের। কিন্তু ছেলেটির দিকে নজর রাখুন। আগামীদিনে জাতীয় রাজনীতির সম্পদ হয়ে উঠতে চলেছে এই ছেলেটি।’‌

মাস লিডার কাকে বলে, এই মূলস্রোত মিডিয়া কখনই বোঝেনি। তাঁদের কাছে, কলকাতার কোনও কাউন্সিলর মানে হেভিওয়েট। পেছনে তিনটে পেটোয়া মস্তান হাঁটলে তিনি জনপ্রিয়। ফেসবুকে ছবি পোস্ট করলে সে জনপ্রিয়। জেলায় কার কত জনভিত্তি, এটা মাপার মতো গভীরতা মূলস্রোত মিডিয়ার আগেও ছিল না। এখন তো আরও নেই। তাঁর লড়াই মাঠে ময়দানে। কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও একটি ছেলে একাই প্রশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। জেলা কার্যত অচল করে দিচ্ছেন। শাসকদলের বাঘা বাঘা নেতারা তাঁর এলাকায় যাচ্ছেন তাঁকে ঠান্ডা করতে, সবক শেখাতে। কিন্তু সেই ছেলে কখনও লড়ছেন এইমসের দাবিতে, কখনও সোচ্চার হচ্ছেন মদ নিষিদ্ধ করার দাবিতে, কখনও হাজার ট্রাক্টরের মিছিল নিয়ে জমায়েত করছেন কৃষি বিলের বিরুদ্ধে। বিধানসভার ভেতর, বিধানসভার বাইরে, তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে সেই কণ্ঠস্বর।

এই বাংলায় মাস লিডার কারা?‌ এক, দুই, তিনে যাচ্ছি না। তবে এটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায়, শাসক–‌বিরোধী সব মিলিয়ে প্রথম পাঁচে থাকবে ভিক্টরের নামটা। তবু বাংলার মানুষের কাছে নামটা ততটা পরিচিত নয়। আসলে, ভিক্টরকে একে–‌তাকে ধরে চ্যানেলে বসতে হয়নি। তাঁকে লম্বা ফেসবুক পোস্ট করতে হয়নি, নিজের ছবি সাঁটিয়ে কটা লাইক পড়ল, সেটা গুনে যেতে হয়নি। বহুবছর তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টই ছিল না। এখন থাকলেও সারাদিন খুলে দেখেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু যখন–‌তখন দশ হাজার মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে দিতে পারেন। এই বাংলায় আর কজনের সেই সাংগঠনিক ক্ষমতা আছে?‌ ২০১৮–‌তে সব ব্লকে যখন তৃণমূল লেঠেল বাহিনী দিয়ে ঘেরাও করছে, শুধুমাত্র একটি বুথে উল্টো ছবি দেখা গেছে। ওই একটি বুথেই সব আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পেরেছিল। সারা বাংলায় ওই একটি আসনেই বামেরা জেলা পরিষদ জিতেছিল। কলকাতার মূলস্রোত মিডিয়ার এসব জানার কথা নয়।

কখনও প্রস্তাব আসে লোকসভায় দাঁড়ানোর। কখনও প্রস্তাব আসে ক্যাবিনেটে পছন্দের দপ্তর বেছে নাও। কিন্তু ‘‌না’‌ বলার মতো এত মনের জোর ছেলেটি কোত্থেকে পান, তিনিই জানেন। ২০২১ ভোটের আগে, হঠাৎ করে হাজির স্বয়ং প্রশান্ত কিশোর। প্রস্তাব দিয়ে বললেন, আপনি যে কোনও তিনটি দপ্তর বেছে নিন। তার মধ্যে কোনও একটি দপ্তরে আপনি এই সপ্তাহেই শপথ নেবেন। সেবার তাঁর দলের বিধায়ক মাত্র দু’‌জন। ফলে, দলত্যাগ বিরোধী আইনেও পড়তে হত না। অনায়াসেই রাজি হতে পারতেন। শপথ নিতেও পারতেন। কয়েকমাস পরেই তো ভোট। শাসকদলের ছত্রছায়ায় এসে সংখ্যালঘু তাস খেলে ড্যাং ড্যাং করে জিতেও যেতেন। কিন্তু এ ছেলে অন্য ধাঁচে গড়া। লড়াই কঠিন জেনে সেই লাল পতাকার ছায়াকেই বেছে নিলেন।

ভোটের পর অনেক জল অনেক দিকে গড়িয়ে গেল। যে লাল পতাকা তিনি ছাড়তে চাইলেন না, সেই দলই কিনা পতাকা থেকে লাল ছেঁটে ফেলতে চাইল। দলের কেউ চাইছেন বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাতে। কেউ চাইছেন, রাজ্যে শাসকের তল্পিবাহক হতে। দুপক্ষের কাছে তিনিই যেন বড় বাধা। তাঁকে বলি দিলেই বোধ হয় কাজটা সহজ হবে। কোনও গঠনতন্ত্রের পরোয়া না করে তাঁকেই কিনা বলি দেওয়া হল!‌ মাসের পর মাস তিনি নিজের লড়াইটা নিজেই লড়েছেন। অন্য কোনও শিবিরে আশ্রয় খোঁজেননি। তখনও ডাক এসেছে শাসকদল থেকে। লোকসভার টিকিট–‌সহ নানা লোভনীয় প্রতিশ্রুতি ছিল। এই অবস্থায় শাসকদলই হতে পারত সেরা আশ্রয়। নিদেনপক্ষে বিজেপি। কারণ, সেই দরজাতেও তো লাল কার্পেট বিছোনোই ছিল। অন্তত রায়গঞ্জ লোকসভার যা ভোটবিন্যাস, তাতে জেতার ব্যাপারে সেটা একটা মাস্টারস্ট্রোক হতেই পারত। কিন্তু তিনি বরাবরই প্রতিকূলে সাঁতার দেওয়া সাঁতারু। তাই তৃণমূল বা বিজেপি নয়, হাত ধরেছেন তুলনায় অনেক দুর্বল কংগ্রেসের।

কিন্তু কী আশ্চর্য। তিনি আসতেই সেই হাতের মরা গাঙে যেন জোয়ার। জেলা পরিষদের চারখানা আসন জিতিয়ে আনা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। এখানেও টিকিটের জোরালো দাবিদার দীপা দাশমুন্সি। যিনি একাধারে প্রিয়রঞ্জনের ঘরনি, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এখনও যিনি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। তাঁর টিকিট তো বাঁধা। কিন্তু তারপরেও ভিক্টরের জনভিত্তির কাছে কোথাও একটা ঝুঁকতে হয়েছে হাইকমান্ডকেও। দীপার দাবিকে উপেক্ষা করে ভরসা রেখেছে তরুণ তুর্কিতে। একদিকে কংগ্রেসের মরা গাঙে জোয়ার আনা, অন্যদিকে বাম শিবিরকে পাশে নামানো। কাজটা খুব সহজ ছিল না। কিন্তু অল্প সময়ে ভিক্টর সেই লড়াইকে এমন একটা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা রাজ্য রাজনীতির শিরোনামে উঠে এসেছে। মুখ্যমন্ত্রীকে একই লোকসভায় তিনবার সভা করতে হয়েছে। ভোটের ফল কী হবে?‌ একদিকে সর্বশক্তি নিয়ে নামা শাসকদল, অন্যদিকে মেরুকরণ জোরদার করা বিজেপি। তার মাঝে তাঁর লড়াইটা বেশ উজ্জ্বল।

ভোটের কিছু নির্দিষ্ট অঙ্ক থাকে। আবার কেউ কেউ এমনও থাকেন, যাঁরা সব অঙ্ককে উল্টে পাল্টে দিয়ে মিরাক্যাল ঘটাতে পারেন। ২০০৯–‌এ এভাবেই সব প্রতিকূল অঙ্ককে উল্টে দিয়েছিল একটি তরুণ। এবারও কি তেমনই মিরাক্যাল!‌ যদি ঘটে যায়, তাহলে সূর্যকান্ত মিশ্রর সেই কথাটা নিশ্চিতভাবেই ফলে যাবে। জেতাটা হয়তো কঠিন। কিন্তু জিতে গেলে নিশ্চিত থাকুন, এই রাজ্য তার সেরা সাংসদকে পেতে চলেছে। ভিক্টর নামের ঝড়টা আছড়ে পড়বে সারা দেশে।
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.