দিল্লির নেতাদের মতো দিলীপ ঘোষ অন্তত ভণ্ড নন

(বেঙ্গল টাইমসের নতুন সিরিজ। উইসফুল থিঙ্কিং। কাদের জয় চান?‌ কাদের পরাজয় চান?‌ দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে খোলা মনেই জানিয়েছেন অনেকে। সেইসব মনোভাবও খোলা মনে তুলে ধরা হল বেঙ্গল টাইমসে)‌

সজল পাত্র

দিলীপ ঘোষকে অনেকেই পছন্দ করেন না। আমার বাপু লোকটিকে বেশ লাগে। বিজেপির অন্য প্রার্থীদের সম্পর্কে আমার তেমন কোনও দুর্বলতা নেই। আমি তাঁদের তেমন সমর্থকও নই। তাঁরা হারলেন নাকি জিতলেন, তা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথাও নেই। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, দিলীপ ঘোষ জিতলে আমার ভালই লাগবে।

তিনিও গ্রামের মানুষ। আমিও গ্রামের মানুষ। তাঁর কথাবার্তায় নাকি হিংসার প্ররোচনা থাকে। যাঁরা এমনটা হলেন, তাঁরা কখনও মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক ভাষণ শুনেছেন?‌ খুব রুচিশীল মনে হয়!‌ তাঁর তুলনায় দিলীপ ঘোষের কথাকে কি অনেক বেশি নিরীহ মনে হয় না?‌ তিনি বিরোধী দলের একজন নেতা। তাঁর সঙ্গে পুলিশ নেই। তিনি কীভাবে কর্মীদের চাঙ্গা করবেন?‌ যখন দেখা যাচ্ছে, পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তখন তিনি কি পুলিশে আস্থা রাখার কথা বলবেন?‌ তিনি কি মুখ্যমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখার কথা বলবেন?‌ তিনি তো স্পষ্টভাষায় বলেন, যে ভাষাটা দুষ্কৃতিরা বোঝে, আমি সেই ভাষাতেই বলব।

তিনি হঠাৎ করে বিজেপি হয়ে যাননি। তিনি হঠাৎ করে শিবির বদল করে অন্যদিকে চলেও যাবেন না। এটুকু ভরসা তাঁকে অন্তত করা যায়। এই বিকিয়ে যাওয়ার যুগে এই আস্থাটুকুই বা কজনের সম্পর্কে রাখা যায়!‌ তিনি গ্রামের মানুষ, যেটা মনে করেন, সেটাই বলেন। শহুরে মানুষের মতো এত রেখেঢেকে কথা বলতে পারেন না। বলার চেষ্টাও করেন না। পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার মিথ্যে ভড়ং তাঁর মধ্যে নেই। তিনি যেটা বিশ্বাস করেন, সেটাই বলেন। বিতর্ক হল কিনা, পরোয়া করেন না।

তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বুঝেছেন, দিল্লির নেতাদের দিকে তাকিয়ে থেকে কোনও লাভ নেই। কারণ, দিনের শেষে দিল্লির নেতারা নানা অঙ্কে তৃণমূলকেই অক্সিজেন দিয়ে যাবেন। তিনি জানেন, সিবিআই–‌ইডির ওপর ভরসা করেও লাভ নেই। তদন্তের নামে তাঁরা যেটা করছেন, সেটা পর্বতের মূষিক প্রসব ছাড়া কিছুই নয়। এই যে সিবিআই মাঝে মাঝেই শীতঘুমে চলে যায়, তদন্তের নামে টালবাহানা করে, এটা কাদের নির্দেশে, এটাও তাঁর অজানা নয়। মাঝে মাঝে সেই হতাশা বেরিয়েও আসে। তাই তিনি তৃণমূলের কাছে যতটা বিড়ম্বনার, নিজের দলের কাছে হয়তো একটু বেশিই বিড়ম্বনার।

গত এক–‌দেড় বছর যে মানুষটি নিজের এলাকায় সবথেকে বেশি সময় দিয়েছেন, তিনি অবশ্যই দিলীপ ঘোষ। মেদিনীপুরেই পড়ে থেকেছেন। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, মেদিনীরপুর থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। নিয়ে যাওয়া হল বর্ধমান–‌দুর্গারপুর কেন্দ্রে। বলা হচ্ছে, স্ট্র‌্যাটেজি। মোটেই তা নয়। আসলে, তাঁকে একটু টাইট দেওয়া। সহজ পিচ থেকে কঠিন পিচে এনে ফেলা। রাজ্যের কেউ কেউ এমনটা চেয়েছিলেন। দিল্লিরও কেউ কেউ নিশ্চিতভাবেই এমনটা চেয়েছিলেন। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি। তিনি কোন কেন্দ্রে দাঁড়াতে চান, তাঁর মতামতটুকুও জানতে চাওয়া হবে না!‌ আসলে, যাঁরা অভিষেক ব্যানার্জিকে কার্যত ওয়াকওভার দিতে চান, যাঁরা কল্যাণ ব্যানার্জিকে তাঁর মনপসন্দ বিরোধী প্রার্থী উপহার দেন, তাঁদের দিলীপবাবুকে পছন্দ হওয়ার কথাও নয়।

মাঝে তাঁকে একবার সেন্সর করা হয়েছিল। তাঁর অপরাধটা কী ছিল?‌ তিনি বলেছিলেন, ১)‌ যারা বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গেল, তারা কেউ আমার হাত ধরে বিজেপিতে আসেনি। যাদের হাত ধরে এসেছে, তাদের জিজ্ঞেস করুন। ২)‌ যারা দিল্লিতে গিয়ে যোগদান করেছেন, তাদের দিল্লির জল হজম হচ্ছে না। ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে গেছে। ৩)‌ কেন তারা তৃণমূলে ফিরে গেল, সেটা পরে ভাবা যাবে। কেন তারা এসেছিল, কেন তাদের নেওয়া হয়েছিল, এখন সেটাই আগে ভাবতে হবে। ৪)‌ শুধু সিবিআই হলেই হবে না। তদন্তের রেজাল্ট চাই। নইলে মানুষের আস্থা থাকবে না।

এর মধ্যে কোনটা ভুল?‌ আসলে, দিল্লির নেতারা বুঝেছেন, তাঁদের চালাকিটা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। কেন বিধানসভায় অর্ধেকের বেশি আসনে ধরে ধরে তৃণমূল থেকে লোক এনে প্রার্থী করা হল, সেই অঙ্কটা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। দিল্লির কোন কোন নেতা তৃণমূলকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন, সেই অঙ্কটাও অন্তত দিলীপ ঘোষের কাছে পরিষ্কার। তৃণমূলকে টিকিয়ে রাখার একটাই উপায়। দলটা তৃণমূলের ছাঁটমালদের এনে বোঝাই কর। এইসব লোককে জামাই আদর করে এনে যদি টিকিট দাও, তাহলে এরা কিছুতেই জিতবে না। এদের ভোট দেওয়ার থেকে মানুষ বরং তৃণমূলকেই দেবে। কারণ, এলাকায় এইসব লোকের যা ইমেজ, তাতে এদের ভোট পাওয়ার কথা নয়।

মোদ্দা কথা, দিল্লির নেতারা চাননি এখান থেকে তৃণমূল সরে যাক। কেন চাননি, সে তাঁদের সমীকরণ। তাঁরা চেয়েছিলেন, কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা যেন একজোট না হতে পারে। সেই কারণে কয়েকটা আঞ্চলিক দলকে অক্সিজেন দিতে হবে। সেই তালিকায় তৃণমূলও আছে। মোদ্দা কথা, তৃণমূল যদি এখানে হেরে যায়, তাহলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। তখন বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সামনে কংগ্রেসের দিকে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না। কিন্তু তৃণমূল যদি এখানে টিকে যায়, তাদের উচ্চাকাঙ্খা আরও বেড়ে যাবে। ‘‌দিদি’‌ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভিন্ন রাজ্যে প্রার্থী দেবেন। তাতে কংগ্রেসেরই ভোট কাটবে। আখেরে লাভ হবে বিজেপির। অসম, গোয়া, ত্রিপুরা সর্বত্র এটাই ছিল ফর্মুলা। তাই তৃণমূলকে একটু অক্সিজেন দিয়ে টিকিয়ে রাখা। সেই কারণে সিবিআই–‌ইডি লোকদেখানো তদন্ত করে। কাজের কাজ কিছুই করে না। নইলে তৃণমূলের বেলুন কবে চুপসে যেত।

সিবিআই শুনেই বিজেপির কেউ কেউ আনন্দে লাফায়। কিন্তু তিনি অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন, এতে উল্লাস দেখানোর কিছু নেই। ঠিক সময় সিবিআই আবার ঘুমিয়ে পড়ে। কাজের কাজ কিচ্ছু করে না। কোন সমীকরণে ঘুমিয়ে পড়ে, একটা বাচ্চা ছেলেও আজ বোঝে। তাই তিনি বারবার বলেন, শুধু তদন্ত হলে হবে না। রেজাল্ট চাই। এসব দিল্লির নেতাদের ভাল লাগার কথাও নয়। লাগেওনি। সেই কারণেই মাঝে মাঝে তাঁর মুখ বন্ধ করার চেষ্টা হয়। নিশ্চিত আসন থেকে কঠিন আসনে ঠেলে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, তাঁর চ্যালেঞ্জটা যত না তৃণমূলের সঙ্গে, তার থেকে অনেক বেশি নিজের দলের সঙ্গে।

দিলীপ ঘোষ দল ভাঙানোয় কখনই তেমন উৎসাহ দেখাননি। দলের কর্মীদের ওপর আস্থা রাখতে চেয়েছেন। দলবদলুদের ধরে এনে প্রার্থী করার বিরুদ্ধেই বারবার মুখ খুলেছেন। যেটা কর্মীদের মনের কথা। আসলে, যেটা সুস্থ রাজনীতির কথা। অথচ, কী মমতা, কী মোদি, তাঁদের যত উৎসাহ অন্যের দল ভাঙানোয়। তাঁদের দিলীপ ঘোষকে ভাল লাগার কথা নয়।

হ্যাঁ, দিলীপ ঘোষকে চেনা যায়, বোঝা যায়। তাঁর মধ্যে অন্তত এটুকু রাজনৈতিক সততা আছে। যেটা এখন বিরল। সেই কারণেই চাই, এই মানুষটা অন্তত জিতুন। দিল্লির নেতাদের ভণ্ডামির থেকে অন্তত সোজা সাপটা দিলীপ ঘোষ অনেক ভাল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.