অমিত ভট্টাচার্য
আমি রাজনীতি খুব যে বুঝি, এমন নয়। কাউকে ভাল লাগে, কাউকে ভাল লাগে না। যুক্তিগুলোও একান্তই আমার মতো। যেমন, আমি বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করি একজনকে। তাঁর নাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এমনকী জ্যোতি বসুর থেকে কাজের নিরিখে তাঁকে এগিয়ে রাখি। আমি মনে করি, আরও কিছুটা আগে তাঁকে দায়িত্ব ছাড়লে রাজ্যের পক্ষে হয়তো আরও ভাল হত। আমি মনে করি, দল থেকে আরও পূর্ণ সমর্থন পেলে তিনি হয়তো আরও ভাল কাজ করতে পারতেন।
আমার কাছে হিসেবটা খুব পরিষ্কার। এই মানুষটার নামে খারাপ কথা শুনতে চাই না। যাঁরা এই মানুষটাকে আক্রমণ করেন, তাঁদের আমি পছন্দ করি না। সেই সমালোচকের যত গুণই থাকুক, আমার কাছে সেগুলো গৌণ। সেই কারণেই আমি কল্যাণ ব্যানার্জির বিরোধী। ২০০৯ এও তাঁর হার চেয়েছিলাম। ২০১৪ ও ১৯ এও একান্তভাবেই তাঁর হার চেয়েছিলাম। এবারও চাই।
কে জিতবেন, সেটা আমার কাছে খুব একটা বড় প্রশ্ন নয়। জেতা উচিত দীপ্সিতার, কিন্তু তিনি না জিতে যদি বেজেপি প্রার্থী জিতে যান, তাও চলতে মারে। মোদ্দা কথা, মন থেকে চাই, কল্যাণ ব্যানার্জি হারুন। তাঁর অন্য কী কী গুণ বা বদগুণ আছে, সেগুলো অনেক পরের ব্যাপার। বুদ্ধবাবু সম্পর্কে তাঁর সেই নোঙরা মন্তব্যগুলোর জন্য আজও তাঁকে ঘৃণা করি। সেদিন কাকে খুশি করতে তিনি এমন কুরুচিকর মন্তব্য করেছিলেন, জানি না। হয়তো ভেবেছিলেন, এই জাতীয় মন্তব্য করলে তাঁর দলনেত্রী খুশি হবেন। দলনেত্রীও তেমনই। তাঁর মুখ থেকেও ভাল কথা কমই বেরোয়। যাঁরা এই জাতীয় নোঙরা ভাষা বলেন, তাঁদের প্রতি দলনেত্রীর একটা বাড়তি প্রশ্রয় বরাবরই দেখা গেছে।
এমপি হিসেবে তিনি কেমন? বিস্তারিত বলতে পারব না। তবে গণমাধ্যমে যেটুকু সামনে এসেছে, তাঁর জন্য গর্বিত হওয়ার মুহূর্ত খুঁজে পাইনি। বরং, তিনি একটি আস্ত ভাঁড়, এমনটাই বারবার মনে হয়েছে। বারবার মনে হয়েছে, এইসব অসভ্য লোকেরা সাংসদ হন কী করে? কারা এঁদের প্রার্থী করে? কারা এঁদের ভোট দেন? কেনই বা দেন? তিনি নাকি আইনজীবী। অথচ, তাঁর কথায় যুক্তি তেমন খুঁজে পাই না। কদর্য ভাষায় অন্যদের আক্রমণ করেন। তিনি নাকি মমতা ব্রিগেডের লোক। তিনি নাকি অভিষেক ব্যানার্জিকে বিশেষ পছন্দ করেন না। অথচ, অভিষেক যখন রাজভবনের সামনে ধর্নায় বসলেন, পদতলে তিনিও বসে পড়লেন। হ্যাঁ, অভিষেক নিজে চেয়ারে বসে, কল্যাণবাবুকে মাটিতে বসিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, আমার পায়ের তলাতেই থাকতে হবে। আমার নেতৃত্ব মেনেই তোমাকে চলতে হবে। কল্যাণবাবুও বুঝলেন, টিকিট পেতে গেলে এছাড়া উপায় নেই। তাই ভাইপোর দাসানুদাস হয়ে গেলেন। আসলে, এইসব লোকেরা কারও অনুগত হতে পারেন না।
আপাতভাবে মনে হচ্ছে, তিনি মমতাকে শ্রদ্ধা করেন। একবার বাদ পড়লেই বোঝা যেত সেই শ্রদ্ধার নমুনা। তাঁর বিজেপিতে যেতে একদিনও সময় লাগত না। এবং সেদিন মমতাকে সবথেকে নোঙরা ভাষায় আক্রমণ হয়তো তিনিই করতেন। দিল্লির বিজেপির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন, মোটামুটি বোঝা যায়। দরজা খুলে রেখেছেন, সেটাও বোঝা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে কে প্রার্থী হবেন, সেটাও তিনিই ঠিক করে দেন। কয়েক মাস আগে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। নিজের প্রাক্তন জামাইকে তিনি বলছেন, ‘আমি খুব চাপে আছি। তুমি টিকিটটা নিয়ে নাও।’ অর্থাৎ, তাঁর বিরুদ্ধে কে প্রার্থী হবেন, তিনি নিশ্চিত করেই রেখেছেন। যিনি হবেন, তাঁর সম্মতির অপেক্ষা।
বলতেই পারেন, এই অডিও–র কী সত্যতা আছে? সেটা যে কল্যাণেরই কণ্ঠস্বর, তা হয়তো প্রমাণ হয়নি। কিন্তু দেড়মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেল। সেটা যে কল্যাণের নয়, সেটাও প্রমাণ হয়নি। কিছু কিছু বিষয় খোলা চোখেই বোঝা যায়। একটু সাধারণ বোধবুদ্ধি থাকলেই বোঝা যায়। অভিযুক্তের বয়ান শুনলেই বোঝা যায়, তিনি সত্যি বলছে না মিথ্যে বলছেন। তদন্তও লাগে না, প্রমাণও লাগে না। কল্যাণবাবু তো সেদিনই এসপিকে অভিযোগ করেছিলেন। তদন্ত করতে বলেছিলেন। তাঁদের সরকারেরই পুলিশ। এরপরও পুলিশ যদি তদন্ত না করতে পারে, সেই দায়টা তাঁকেই নিতে হবে। অন্যদিকে, বিজেপি প্রার্থী। তাঁর বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ। তাঁরা কেন্দ্রে ক্ষমতায়। তিনিই বা কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দিয়ে তদন্তের দাবি তুললেন না কেন? বিজেপি নেতারাই বা নীরব কেন? বেচারা কবীরশঙ্করের হয়ে একজন নেতাকেও বিবৃতি দিতে দেখা গেল না কেন? তাঁরাও জানেন, দিল্লির সঙ্গে বোঝাপড়ায় কল্যাণই এমন ললিপপ প্রার্থী ঠিক করেছেন। তিনি কল্যাণের ‘ডামি’ ছাড়া আর কিছুই নন।
লড়ে যাচ্ছেন একটি মেয়ে। কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি। ইউটিউবের নানা ভিডিও এসে যায়। মেয়েটির কথা শুনছি। বেশ লাগে। মনে হচ্ছে, হ্যাঁ, এই উজ্জ্বল মেয়েটিরই যাওয়া উচিত সংসদে। তিনি কি জিতবেন? এখনই এতখানি আশাবাদী হতে পারছি না। শুনতে খারাপ লাগবে, তবু বলছি, এমন একজনকে সাংসদ হিসেবে পাওয়ার যোগ্যতা এখনও শ্রীরামপুরের মানুষ অর্জন করেননি। তবে মাত্র কয়েকদিনে লড়াইটাকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন। কল্যাণবাবু, অনেক হয়েছে। এই অসভ্যতা, এই ভাঁড়ামি এবার বন্ধ হোক। এবার বিদায় নিন। হারা মানু্ষের প্রতিও একটা সহানুভূতি থাকে। কিন্তু তাঁর জন্য সেটুকুও থাকবে না। ওই যে, সেই পনেরো–ষোল বছর আগে বুদ্ধবাবুকে নোঙরা ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। তার কোনও ক্ষমা নেই।