কোনটা সাফল্য, কোনটা ব্যর্থতা, প্রধানমন্ত্রী আদৌ বোঝেন!‌

রক্তিম মিত্র

প্রধানমন্ত্রী শব্দটার একটা আলাদা ওজন আছে। এই চেয়ারের একটা আলাদা মর্যাদাও আছে। তার ওপর জোর প্রচার, নরেন্দ্র মোদি নাকি বিশ্বগুরু। তিনি নাকি বিশ্বের সবথেকে প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কদের একজন। ভক্তকূলের দাবি, তিনি এই দেশের সর্বকালের সেরা প্রধানমন্ত্রী।

শুরুর দিকে এই মানুষটির সম্পর্কে কিছুটা প্রত্যাশা আমারও ছিল। বছর দশেক আগে, যখন নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে, যখন তাঁকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার একটা প্রবল চেষ্টা হচ্ছে, মনে হয়েছিল, এই মানুষটির মধ্যে একটা ভিশন আছে, একটা প্যাশন আছে। রাজনৈতিক মত যাই হোক, এই মানুষটি নিজের কাজ দিয়ে কিছু অন্তত ছাপ রেখে যাবেন।

কিন্তু যতই সময় গড়াল, মোহভঙ্গ হলে সময় লাগল না। প্রধানমন্ত্রী বলতে যে সম্ভ্রমটা তৈরি হত, তা আজ আর হয় না। বরং এই পদে আসীন মানুষ নিজেকে কতটা হাস্যকর করে তুলতে পারেন, সেটা দেখে বিস্মিত হই। সেই ছোটবেলায় শোনা একটা কথা, ‘‌নিজে যারে বড় বলে, বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়।’‌ এই প্রধানমন্ত্রীর ঢাক বাজানোর লোকের অভাব নেই। কিন্তু তারপরেও নিজেই নিরন্তর নিজের ঢাক বাজিয়ে যান। ‘‌তিনিই শ্রেষ্ঠ’‌ এটা প্রমাণ করতে গিয়ে যেভাবে পূর্বতনদের খাটো করেন, তা দেখে এটুকু অন্তত বুঝতে পারি, ওই চেয়ারে বসতে গেলে যে মানসিক উচ্চতা লাগে, তা অন্তত এই মানুষটির নেই।

এই বাংলায় তিনি যখনই প্রচারে আসেন, নিজের ঢাক পেটাতে গিয়ে আসলে নিজের ব্যর্থতার বিজ্ঞাপনই করে যান। কোনটা তাঁর সাফল্য, কোনটা তাঁর ব্যর্থতা, এই সহজ বিষয়টাও বোঝেন বলে মনে হয় না। ২০১৪–‌র কথা না হয় ছেড়ে দিলাম। তখনও তিনি দায়িত্বে আসেননি। কিন্তু তারপর, ২০১৬, ২০১৯, ২০২১ এই নির্বাচনগুলিতে বারেবারেই প্রচারে এসেছেন। প্রায় সব সভাতেই নিয়ম করে চিটফান্ডের কথা তুলে এনেছেন। নানা দুর্নীতির কথা তুলে এনেছেন। তিনি কড়া ব্যবস্থা নেবেন, এমন আশ্বাস দিয়ে গেছেন। সবিনয়ে জানতে ইচ্ছে করে, এইসব তদন্ত কারা করছে?‌ সেই সিবিআই–‌ইডি বছরের পর বছর ঘুমিয়ে আছে, এই দায় কার?‌ যে তদন্ত হতে সাতদিন লাগে না, দশ বছর ধরে তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এরপর ওই সব বিষয় নিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছেন?‌ এই দশ বছর তো তিনিই ছিলেন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই ছিলেন। ব্যবস্থা নিতে কে বারণ করেছিল?‌ এবার দশ–‌কুড়িটা আসন বেশিও পান, কী করবেন?‌ এখনই লিখে রাখুন, এবারের হুঙ্কারও সেই ফাঁপা আওয়াজ হয়েই থাকবে। কিছু করার হলে আগেই করতে পারতেন।

মাঝে মাঝেই তিনি গরু পাচার, কয়লা পাচারের কথা বলেন। অনেক বছর ধরেই বলছেন। আচ্ছা, সীমান্ত পাহারার দায়িত্ব কার?‌ নিশ্চয় রাজ্য সরকারের নয়!‌ এত এত রাজ্য বেয়ে গরুর ট্রাক এই রাজ্যে ঢুকছে কীভাবে?‌ কয়লার বিষয়টা কারা দেখে?‌ নিশ্চয় রাজ্য সরকার নয়। অবৈধ খাদান হলে, অবৈধ পাচার হলে দেখার দায়িত্ব কার?‌ সেই সিআইএসএফ নিশ্চয় রাজ্যের আওতাধীন নয়। অর্থাৎ, গরু পাচার হোক বা কয়লা পাচার, কেন্দ্র নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারে না বলেই হয়। সুতরাং, কেন গরু পাচার হচ্ছে, কেন কয়লা পাচার হচ্ছে, এই নিয়ে ভোটের ময়দানে হুঙ্কার না ছেড়ে নিজের দায়িত্ব পালনে সচেতন হোন। আগে জানুন, গলা ফুলিয়ে গরু পাচার হয় বলে থাপ্পড়টা আসলে নিজের গালেই মারছেন।

এত কিছু পরেও গরু, কয়লা পাচার অবাধে হচ্ছে কেন?‌ যারা অপরাধী, তারা এত বেপরোয়া কেন?‌ কারণ, তারা জানে, প্রধানমন্ত্রীর কোনও মুরোদ নেই। তিনি শুধু ভোটের আগে হাওয়া গরম করতেই ভালবাসেন। নিজের যেটা দায়িত্ব, সেটা পালন করতেন পারেন না।

এর আগে অনেক প্রধানমন্ত্রী দেখেছি। তাঁদের অনেকেরই নানা বিষয়ে হয়তো সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু নিজের ব্যর্থতাকে নিয়ে এমন নির্লজ্জ বিজ্ঞাপন করতে কাউকে দেখা যায়নি।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.