এইসব কালজয়ী গান আমার বাবা লিখেছেন!‌

একেকটা গানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কত অজানা গল্প। কীভাবে সেই গান লেখা হল?‌ কার জন্য লেখা, কে গাইলেন!‌ বাবা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে শোনা তেমনই কিছু গানের কথা মেলে ধরলেন পিয়াল বন্দ্যোপাধ্যায়।

হেমন্ত মুখার্জি মানে এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁকে দূর থেকে শ্রদ্ধা করা যায়। কিন্তু কাছে গেলেই কথা হারিয়ে যায়। এমন একজন মানুষের সামনে কী কথা বলব!‌ তাই অনেকবার কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলেও সেভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলার বা আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়নি।

তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আমিও তাঁর বাড়িতে গেছি। এমনকী বম্বের বাড়িতেও গেছি। কিন্তু তারপরেও ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ হয়নি। প্রথমত, আমি তখন অনেকটাই ছোট। বড়দের কথার মাঝে ঢোকা ঠিক নয়, এটা জানতাম। তাঁর সঙ্গে আমার বাবা অর্থাৎ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা হচ্ছে। মূলত গান নিয়ে, সিনেমা নিয়ে, এই জগতের মানুষদের নিয়ে। সেখানে আগ বাড়িয়ে আমার কিছু বলতে যাওয়াটা শোভনীয় হত না। তাছাড়া, তখন এসব তেমন বুঝতামও না। তাই বাবা কথা বলতেন হেমন্তবাবুর সঙ্গে। মা কথা বলতেন ওঁর স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আমি হয়ত রানুর সঙ্গে গল্প করছি। যেসব বিষয়ে আড্ডা হত, তখন সেসব কথার মানে বুঝতাম না। এখন নিজে সিনিয়র সিটিজেন হওয়ার পর কিছুটা বুঝতে পারি। আমার সঙ্গে হেমন্তবাবুর শেষ দেখা আমার বিয়ের সময়। উনি তখন খুবই অসুস্থ। সেই অসুস্থ শরীর নিয়েও এসেছিলেন। উপরে উঠতে পারেননি। নিচে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিলেন। ওই শরীর নিয়ে না এলেও পারতেন। কেউ রাগ করত না। তবু এসেছিলেন বাবার সঙ্গে তাঁর এত বছরের সম্পর্ককে মর্যাদা দিতে।

গান বাজনার ভেতরের কথা নিয়ে বাবাও বাড়িতে খুব একটা আলোচনা করতেন না। তাই বাবার কাছেও খুব বেশি গল্প শোনার সুযোগ হয়নি। উনি হয়ত অন্যদের বলছেন বা ফোনে কাউকে কিছু বলছেন, সেখান থেকে শুনেছি। বাবার অন্যান্য বন্ধু ও পরিচিতদের কাছ থেকে শুনেছি। সেইসঙ্গে বাবার লেখা বই পড়েও কিছুটা জেনেছি। সবকিছু খুঁটিনাটি সাল–‌তারিখ মনে নেই। আমার স্মৃতিশক্তিও ভাল নয়। তাছাড়া, বাবার মতো আমি গুছিয়ে লিখতেও পারি না।

pulak babu1বাবার সঙ্গে হেমন্তবাবুর পরিচয় উনি গানের জগতে আসার অনেক আগে থেকেই। ভবানীপুরে ছিল বাবার দিদির বাড়ি। দুই ভাগ্নে। বড় ভাগ্নে সুশীল চক্রবর্তী বয়সে বাবার থেকে কিছুটা বড়ই ছিলেন। তিনি ছিলেন হেমন্তবাবুর বন্ধু। আরেকজন উত্তম কুমারের বন্ধু। দুজনেই ভবানীপুরের সেই বাড়িতে আসতেন। বাবাও যেতেন। তখন থেকেই বাবার সঙ্গে এঁদের পরিচয়। তখনও হেমন্তবাবু বিখ্যাত হননি, উত্তম কুমার তখন পাড়ায় শখের যাত্রা করতেন, সিনেমা থেকে বহু যোজন দূরে। যেহেতু মামার বন্ধু, সেই সূত্রে উত্তম কুমার বাবাকে মামা বলেই ডাকতেন। বাবার সেই বড় ভাগ্নের বিয়েতে হেমন্তবাবু এসে গান গেয়েছিলেন। এক কোনে বসে শুনেছিলেন উত্তম কুমার।

বাবারও তখন থেকেই একটু একটু গান লেখা শুরু। যতদূর শুনেছি, হেমন্তবাবু বাবার লেখা গান প্রথম করেন রামচন্দ্র পালের সুরে, প্রদীপ কুমারের লিপে। ছবির নাম অপবাদ। বাবা তখন থার্ড ইয়ারে পড়েন। তারপর হেমন্তবাবু বম্বেতে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। খুব নামডাক হয়। মাঝে মাঝে যখন কলকাতায় আসতেন, বাবা দেখা করতে যেতেন। বাবার লেখা গান তখন অনেকেই গাইছেন, কিন্তু বারবার দেখা হলেও হেমন্তবাবুকে গান রেকর্ড করার কথা কিছুতেই বলতে পারছেন না। চেনা মানুষদের কাছে বরাবরই সঙ্কোচটা একটু বেশি হয়। অন্যদের কাছে যে আবদার করা যায়, চেনা মানুষদের কাছে সেই আবদার করা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একদিন এক ঘরোয়া আড্ডায় বাবা হেমন্তবাবুকে গান রেকর্ড করার প্রস্তাব দিলেন। উনি তখন বললেন, ‘‌কই, তুমি তো আমাকে আগে কোনওদিন বলোনি। কোনও গান সঙ্গে এনেছো?‌’ বাবা পকেট থেকে তিন চারটি গান বের করলেন। প্রথমেই পড়লেন, ‘‌ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না/‌ ও বাতাস আঁখি মেলো না।’ মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে হেমন্তবাবু বললেন, ব্যস ব্যস, আর শোনাতে হবে না। এখন আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। ‌‌একটুও সময় নেই।’‌
এটা শোনার পর যে কোনও তরুণ গীতিকারের মন ভেঙে যেতে বাধ্য। গানটা নিশ্চয় পছন্দ হয়নি। পুরোটা শুনলেনও না!‌ মাঝপথে থামিয়ে দিলেন!‌ গানের প্রস্তাব না দিলেই বোধ হয় ভাল হত।
হেমন্তবাবু যাওয়ার আগে বলে গেলেন, আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। তোমার এই গানটা আর এর উল্টো পিঠে তোমার পছন্দের একটা গান লিখে বম্বের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিও। আমি পরেরবার এসে রেকর্ড করব।
তখন বাবার তো বাকরুদ্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। এ যেন হাতে চাঁদ পাওয়া। কয়েক লাইন শুনেই একেবারে প্রতিশ্রতি দিয়ে দিলেন!‌ ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না— এটাই হেমন্তবাবুর কণ্ঠে রেকর্ড করা বাবার প্রথম আধুনিক গান। উল্টো পিঠে ছিল— কত রাগিনীর ভুল ভাঙাতে। দুটো গানই এতটা কালজয়ী, আজও শোনা যায়।
এভাবেই নতুন এক সম্পর্কের শুরু। সারাজীবন এই গানের সম্পর্ক দুজনেই ধরে রেখেছেন। বাবা বরাবরই বলতেন, ‘‌আমার গানের দুই স্তম্ভ— একজন মান্না দে, আরেকজন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আমি আজ যেটুকু স্বীকৃতি পেয়েছি, এই দুজনের জন্য।’‌ এই দুজনের প্রতি বাবার কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। এঁদের সম্পর্কে কেউ খারাপ কথা বললে বাবা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিতেন।
একেকটা গানের পেছনে কত গল্প লুকিয়ে থাকে। সেইসব আড়ালের কথা আড়ালেই থেকে যায়। তার কতটুকুই বা আমরা জানি!‌ বাবা কিছুটা লিখে গেছেন। তার অনেকগুন বেশি তাঁর মনেই থেকে গিয়েছিল। কারণ, বয়স হলে এমনিতেই স্মৃতি দুর্বল হয়ে আসে। তাছাড়া, সব কথা প্রকাশ্যে আনতেও নেই। দু–‌একটা মজার কথা বলা যাক।

মণিহার ছবির গান তৈরির কাজ চলছে। গানের সিকোয়েন্স বোঝানো হচ্ছে। পরিচালক, প্রযোজক সবাই আছেন। হেমন্তবাবু সুর করে ফেলেছেন। গাইবেন লতা মঙ্গেশকার। বাবা দ্রুত লিখে ফেললেন কয়েকটা লাইন, ‘‌নিঝুম সন্ধ্যায়/‌পান্থ পাখিরা/‌বুঝিবা পথ ভুলে যায়।’‌ সবার পছন্দ হয়েছে। এবার পরের লাইনগুলো লিখতে যাচ্ছেন। হেমন্তবাবু থামিয়ে দিলেন, এত সুন্দর গান। এখন তাড়াহুড়ো করে লিখতে হবে না। দুদিন সময় নাও। বাড়িতে বসে বাকিটা লিখবে। তিনদিন পর আবার সবার সামনে বাকিটা হবে।
সবাই উঠে চলে যাচ্ছেন। বাবাও উঠতে যাচ্ছেন। হেমন্তবাবু বললেন, পুলক একটু দাঁড়িয়ে যাও। আমি তোমাদের ওদিকেই যাব।
বাবা বসে পড়লেন। অমনি হেমন্তবাবু কাছে হারমোনিয়াম টেনে নিলেন। বললেন, আজ তোমার মুড খুব ভাল আছে। আমারও ভাল মুড। বাকিটা এখনই তৈরি করে ফেলো। সেই সুরে বাবা লিখে ফেললেন অন্তরা— ‘‌দূর আকাশের উদাস মেঘের দেশে/‌ওই গোধূলির রঙিন সোহাগে মেশে।’‌ পনেরো মিনিটের মধ্যেই গোটা গানটা তৈরি। দুজনেই দারুণ খুশি। এ যেন সৃষ্টিসুখের উল্লাস। যাঁরা স্রষ্টা, শুধু তাঁরাই এই অনুভূতিটা বুঝতে পারেন।
বাবা গানটা হেমন্তবাবুকে দিতে গেলেন। উনি বললেন, এটা তোমা কাছেই রেখে দাও। তিনদিন পর সবার সামনে বের করবে। তুমি এখনই লিখে ফেললে, আর আমি এখনই সুর করে ফেললাম, এটা শুনলে ওরা ভাববে আমরা দুজনেই ফাঁকি মেরেছি। তার থেকে ওরা বরং ভাবুক আমরা দুজনেই খুব গলদঘর্ম হয়ে দুদিন ধরে গানটা তৈরি করেছি।
তিনদিন পর যথারীতি বাবা সবার সামনে গানটা পকেট থেকে বের করলেন। হেমন্তবাবুর সুর তো তৈরিই ছিল। বাকিদের সামনে গেয়ে শোনালেন। অর্থাৎ, নিখুঁত চিত্রনাট্য মেনে দুজন অভিনয় করলেন। কেউ বুঝতেই পারল না গানটা তিনদিন আগেই তৈরি হয়ে গেছে।
একবার ডিসেম্বর নাগাদ হেমন্তবাবু পুজোর গান চেয়ে বসলেন। বাবা বললেন, পুজো তো অনেক দেরি। এখন থেকে গান চাইছেন!‌ হেমন্তবাবু বললেন, জানুয়ারি থেকেই সবাই পিছনে পড়ে যাবে। সবাই চাইবে, তাদের লেখায়, সুরে আমাকে গান গাওয়াতে। কজনকে ফেরাব?‌ আর আমি এত মিথ্যে বলতেও পারব না। তার থেকে তুমি বাপু আগেই তৈরি করে দাও। আমি যেন বলতে পারি, আমার গান তৈরি হয়ে গেছে। এছাড়া বাঁচার আর কোনও উপায় নেই।
আরেকবার বাবা অনেকদিন পর হেমন্তবাবুর বাড়ি গেছেন। হেমন্তবাবু বসলেন, আরে পুলক, কতদিন পরে এলে বলো তো!‌
বাবা অমনি লিখে ফেললেন, ‘‌কতদিন পরে এলে/‌একটু বোস/‌তোমায় অনেক কথা বলার ছিল/‌ যদি শোন।’ এভাবেই তৈরি হয়ে গেল কালজয়ী একটা গান। ‌
বাবার লেখা গল্প নিয়ে তৈরি হচ্ছে রাগ–‌অনুরাগ। সঙ্গীত পরিচালক যথারীতি হেমন্তবাবু। ঠিক হল, ছটা গান গাইবেন হেমন্তবাবু, একটা গান লতা মঙ্গেশকার। মহিলা কণ্ঠের গানটা তৈরি হচ্ছে। বাবা একটা গানের মুখরা লিখেছেন। অন্তরাটা লিখছেন। হঠাৎ হেমন্তবাবু থামিয়ে দিলেন। বললেন, এটা হচ্ছে না। অন্য সুর করছি। তুমি অন্য গান লেখো।
বাবা ভাবলেন, ছবির গান মুলতুবি। এখন বোধ হয় আধুনিক গান লিখতে বলছেন। হেমন্তবাবু বললেন, না না, তোমার ছবির সিকোয়েন্স ভেবেই বলছি। এই কথাগুলো ঠিক মানানসই হচ্ছে না। বাবা তো অবাক। তিনি নিজে কাহিনী লিখেছেন। হেমন্তবাবু চিত্রনাট্যও পুরোটা শোনেননি। শুধু গল্পের সারসংক্ষেপ শুনেছেন। সেখানে হেমন্তবাবু সিকোয়েন্স নিয়ে ভাবছেন!‌ হেমন্তবাবুই শুরুটা বলে দিলেন। লেখা হয়ে গেল, ‘‌ওই গাছের পাতায়/‌রোদের ঝিকিমিকি/‌আমায় চমকে দাও।’‌ এভাবেই হেমন্তবাবু কত গান ধরিয়ে দিয়েছেন। কত গান শুরু করে দিযেছেন। শুনেছি, হেমন্তবাবু ‘‌গাছের পাতায়’‌ গানের শুরুটা বলার পরই বাবা দ্রুত গানটা লিখেই তৎক্ষণাৎ কাগজ–‌কলম ছুঁড়ে ফেলে হেমন্তবাবুকে প্রণাম করেছিলেন। তখন এই ছিল সুরকার–‌গীতিকারের শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক। এখন এগুলো রূপকথা মনে হবে।

এভাবেই কত কালজয়ী গান তৈরি হয়েছে। কত ইতিহাস লুকিয়ে আছে সেইসব গানের পেছনে!‌ এত বছর পরেও পুজো প্যান্ডেল থেকে বিয়েবাড়ি, রিয়েলিটি শো থেকে সিরিয়াল, মাঝে মাঝেই বেজে ওঠে সেইসব গান। ভাবতে গর্ব হয়, এইসব কালজয়ী গান আমার বাবা লিখেছেন!‌

********

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.