‌তোমার বাড়ি আমার বাড়ি মকাইবাড়ি, মকাইবাড়ি

আজ বিশ্ব চা–‌পান দিবস। চা নিয়ে, চা–‌পান নিয়ে নানা সময় নানা আকর্ষণীয় লেখা প্রকাশিত হয়েছে বেঙ্গল টাইমসে। এই দিনটিতে তেমনই দুটি পুরনো লেখা ফিরিয়ে আনা হল। এই লেখা মকাইবাড়ির বাগান নিয়ে। সেই বাগানের মালিকানায়, চালচিত্রে কিছুটা বদল এসেছে ঠিকই, তবু লেখাটি পড়ুন, ভাল লাগবে।

স্বরূপ গোস্বামী

রাজাবাবু,

এ কোনও রাজার নিকট প্রজার চিঠি নয়। কিন্তু কী করব! আপনার নামই যে রাজা! রাজা ব্যানার্জি। আঁতলামি করে রাজাদা বলব, এমন ধৃষ্টতা যেন কখনও না আসে। অগত্যা, রাজাবাবু। এছাড়া আর কী বলেই বা সম্বোধন করতাম!
বেশ কয়েকবার আপনাকে দেখেছি। কখনও কাছ থেকে, কখনও একটু দূর থেকে, আবার কখনও অনেকটা দূর থেকে। কতবার ভেবেছি, এগিয়ে যাই, প্রণাম করি। ইচ্ছে হয়েছে, আপনার সঙ্গে আপনার বাগানে ঘুরে বেড়াই। শুধু চা নিয়েই আপনার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করি। কী জানি, কী ভেবে নিজেকে বারবার গুটিয়ে নিয়েছি। আপনি তাই আমার কাছে দূর গ্রহের তারা হয়েই থেকে গেছেন।

অন্নদাশঙ্কর রায় একবার বলেছিলেন, ‘বড় মানুষদের কাছে যেতে নেই। তারা অনেক ছোট হয়ে যায়।’ নিজের পেশাগত জীবনেও বহু গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। দেখেছি, কীভাবে তাঁদের ভাবমূর্তির দেওয়ালে চোখের সামনে পলেস্তারা খসে গেছে। মিলিয়ে নিয়েছি অন্নদাশঙ্করের এই কথার সারসত্য। আপনার সান্নিধ্যে এলে আপনিও কি আমার কাছে ছোট হয়ে যেতেন! শ্রদ্ধার ইমারত থেকে ইটগুলো কি খসে পড়ত! জানি না, জানার দরকারও নেই। আপনি প্রণম্য ছিলেন, আছেন, থাকবেন।

makaibari3

আপনার বাগানে প্রথম যাই বছর চারেক আগে। বিশ্বাস করুন, তার আগে মকাইবাড়ি টি এস্টেটের কথা শুনলেও আপনার নাম কখনও শুনিনি। দোষটা আপনার নয়, একান্তই আমার। নিজের এই অজ্ঞতার কথা ভাবলে এখন নিজেরই হাসি পায়। এমনকি প্রথম যেবার গেলাম, সেবার দু রাত থাকলেও আপনাকে নিছক একজন মালিকের বেশি কিছু ভাবিনি। সব বাগানেই একজন মালিক থাকে, আপনিও আছেন। এত আদিখ্যেতার কী আছে! বামপন্থী আবহে বেড়ে ওঠা, তাই শুরুতেই মালিক মানে শ্রেণিশত্রু ভেবে নেওয়ার একটা বদভ্যেস আছে। শুনেছিলাম, চার পুরুষের বাগান। আর তাই সরলীকরণ করে নিয়েছিলাম, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছেন। বিলাস আর বৈভবে কেটেছে তারুণ্য, যৌবন। আপনি হয়ত বড় লোকের বখাটে ছেলের মতোই। বাপ ঠাকুরদা রেখে গেছেন, আপনি হয়ত পায়ের ওপর পা তুলে আয়েস করে যাচ্ছেন। শুনলাম, আপনার পড়াশোনা সব লন্ডনে। তখনও তেমন সমীহ জাগেনি। বাপের টাকা থাকলে লন্ডনে পড়াশোনা করা কী এমন আহামরি ব্যাপার! মোদ্দা কথা, সেবার আপনাকে ঘিরে আলাদা কোনও অনুভূতি তৈরি হয়নি। আসলে, আপনার কর্মীদের সঙ্গে, এলাকার সাধারণ নেপালিদের সঙ্গে সেভাবে মেশার সুযোগই হয়নি। বাগানের বৃত্তান্ত জানারও তেমন অবকাশ হয়নি। শুধু পর্যটকের তকমা লাগিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে গেছি। মানতেই হবে, বাগানটা দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে দাগ কেটে যায়। সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে কার আর ইতিহাস কপচাতে ইচ্ছে করে! আর তখন জানার তেমন সুযোগও ছিল না। কারণ, আশেপাশে লোকাল গাইড বলে কেউ ছিল না। কলকাতা থেকে যাওয়া তিন আগন্তুক। কেউই কিছু জানি না। যাওয়ার আগে পড়াশোনা করেও যাইনি। বাঙালির জীবনে তখনও গুগল সার্চের বা উইকিপিডিয়ার এতখানি চল ছিল না। জানার মধ্যে জেনেছিলাম, আপনার বাগানের চা তখনই নাকি বাইশ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হত। বেশিরভাগ চা নাকি বিদেশে চলে যায়। তখন বুঝলাম, আপনি ব্যবসাটা করতে জানেন। ব্যবসা বিমুখ হিসেবে বাঙালির একটা দুর্নাম আছে। বুঝলাম, আপনি একটু ব্যতিক্রমী। পরে এক ড্রাইভারের মুখে শুনলাম, গোটা দার্জিলিংয়ে একসময় অধিকাংশ বাগানই ছিল বাঙালিদের। এখন সব হাত বদল হয়ে গেছে। কেউ মারোয়াড়ি–গুজরাটিদের বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার কেউ বা কোম্পানির হাতে বাগান তুলে দিয়েছেন। গোটা পাহাড়ে বাঙালি মালিক বলতে একমাত্র আপনি। এসব যখন জানতে শুরু করেছি, তখন কার্শিয়াং ছেড়ে কালিম্পংয়ের দিকে রওনা দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল।

makaibari1

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার গেলাম। অথচ, সেবার আমাদের পর্যটন মানচিত্রে কোথাও কার্শিয়াং বা মকাইবাড়ি থাকার কথাই নয়। গিয়েছিলাম সিকিম। ফেরার পথে কেন জানি না মনে হল, একবার মকাইবাড়ি হয়ে গেলে কেমন হয়! চলে গেলাম। গিয়েই পড়লাম বিপদে। শুনলাম, বিমল গুরুংরা লাগাতার অবরোধ ডেকে বসে আছেন। পরের দিনেই ট্রেনে টিকিট কাটা আছে। যেভাবেই হোক, নামতেই হবে। সর্বনাশ, নামব কী করে! প্রেস স্টিকার লাগিয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত নেমে আসব, তারও উপায় নেই। কোনও ড্রাইভার রাজি নয়। কী করা যায়! কীভাবে যে তিনটে মোটরবাইক জোগাড় হয়েছিল, সে এক রূপকথার মতোই। তিনজনের পিঠেই ভারি ব্যাগ। পাঙ্খাবাড়ির ওই খাড়া রাস্তা দিয়ে প্রাণ হাতে করে নেমেছিলাম। নিচের দিকে তাকাচ্ছিলাম,আর ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। বাকি দুই চালক ছিল নেপালি। কিন্তু আমি বসেছিলাম সঞ্জয়ের বাইকে। এই রে, নামটা ফাঁস করে দিলাম! একদিক দিয়ে ভালই হল। এত রহস্য রেখে লাভ কী! ফ্যাক্টরির দায়িত্বে থাকা, আপনার প্রিয়পাত্র সঞ্জয় যে আমারও বড় প্রিয় পাত্র। আমার থেকে এক ক্লাস জুনিয়র। কিন্তু, আমাদের শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের দামাল দিনগুলো যে একসঙ্গেই কেটেছে। স্কুল, টিউশানি কেটে ভরদুপুরে ক্রিকেটই হোক, লুকিয়ে সিনেমায় যাওয়াই হোক, আর সাঁওতাল পাড়ায় আম বা কুল পাড়তে যাওয়াই হোক, এমন অনেক দস্যিপনাই একসঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি। এমন কত দুপুর গড়িয়েছে বিকেলে, কত রাত খুঁজে নিয়েছে ভোরের ঠিকানা। নাচ থেকে জিমনাস্টিক্স, ক্রিকেট থেকে পড়াশোনা, সব ব্যাপারেই ছিল তুখোড়। যা চাইত, তাই হতে পারত। কখনও মনে হত বড় ক্রিকেটার হবে, পরক্ষণেই মনে হত, ভাল ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে, নিদেনপক্ষে বড় আমলা হবে। কিন্তু ও যে এভাবে চায়ের দুনিয়ায় ঢুকে পড়বে, তা ভাবতেও পারিনি। ও নিজেও ভাবেনি। গ্র‌্যাজুয়েশনের পর হঠাৎ করেই ভর্তি হয়ে গেল প্ল্যান্টেশন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। জড়িয়ে গেল চায়ের দুনিয়ায়। ভালবেসে ফেলল মকাইবাড়িকে। বিশ্বাস করুন, ওকে ঘিরে কোনও আক্ষেপ নেই। বরং, বেশ গর্বই হয়। এশিয়ার সেরা চা আমার বন্ধুর হাতে তৈরি, এটা ভাবতে গর্ব হবে না! এখন মনে হয়, ভাগ্যিস ও এই দুনিয়ায় এসেছিল। নইলে তো, মকাইবাড়িকে, আপনাকে চেনাই হত না।

তাহলে, প্রথমবার আপনাকে চেনার ক্ষেত্রে ভুল হয়েছিল কেন? আসলে, সেবার ছিল পাতা তোলার সময়। ফলে, ওকে সকাল থেকে রাত, প্রায় সবসময়ই ফ্যাক্টরিতেই কাটাতে হয়েছিল। চাইনি ওকে বিব্রত করতে। আমরা ঘুরেছিলাম আমাদের মতো করেই। তাই, অনেক ফাঁক থেকে গিয়েছিল। তারপর অফিসের কাজের সূত্রে চলে গেলাম উত্তরবঙ্গে। ছিলাম চোদ্দ মাস। আরও বেশি করে জড়িয়ে গেলাম আপনার বাগানের সঙ্গে। শিলিগুড়ি থেকে মকাইবাড়ি কতই বা দূর! মন খারাপ লাগলেই চলে যেতাম। কখনও সকালে বেরিয়ে সাতটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম। দুপুরে নেমে এসে অফিস করলাম। কখনও শীতের রাতে জমজমাট আড্ডা। একা একাই ঘুরেছি আপনার বাগানে। অনেকটা নিজের বাড়ি বলেই মনে হত। আপনার কাছেই তো সেই ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি। সেখানে গণ অভ্যুত্থানের সময় একটা স্লোগান উঠেছিল, ‘তোমার নাম, আমার নাম/ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।’ তখন আমার জন্মও হয়নি। কিন্তু স্লোগানটার কথা কতবার যে শুনেছি! ওই ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করত, ‘তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি/মকাইবাড়ি মকাইবাড়ি।’

makaibari4

থাক এসব কথা। একটু চায়ের কথায় আসি। এত বড় বাগান। তাহলে জঙ্গলটা কত বড়! আপনার বাগানের সত্তরভাগ জুড়ে নাকি শুধু জঙ্গল। এমনিতেই পাহাড় ঢেকে থাকে মেঘ আর কুয়াশায়। তার পর যদি ওই পাহাড়ে আরও গহন অরণ্যে ঢুকে পড়ি! সেই পাইনের বনে সূর্যের আলোও ঢোকার ছাড়পত্র পায় না। যেখানে সকালে ঢুকলেও গাইতে ইচ্ছে করে, ‘এ কোন সকাল/রাতের চেয়েও অন্ধকার।’ সেই জঙ্গলে শুনেছি তিনখানা বাঘ আছে! ভয়েই গভীরে ঢুকতে পারিনি। অথচ, আপনি কী অবলীলায় সেই জঙ্গলে একা একা মাটিতে শুয়ে থাকতে পারেন। ঘন্টার পর ঘন্টা ঘরে সেই নির্জনে শুধু পাখির ডাক শুনে কাটিয়ে দিতে পারেন! প্রতিটি গাছের জন্মবৃত্তান্ত নাকি আপনার মুখস্থ। মাঝে মাঝে ভাবি, আপনার জায়াগায় অন্য কোনও মালিক থাকলে কী করতেন! গাছপালা সাবাড় করে সেই সত্তরভাগ জায়গায় চা গাছ লাগিয়ে দিতেন। বছরে কয়েক হাজার কোটির বাড়তি মুনাফা কে ছাড়ত! অথচ আপনি! একটি গাছও কখনও কাটতে দেননি। শুধু জঙ্গল দেখভালের জন্য নিজের টাকায় এগারোজন ফরেস্ট রেঞ্জার রেখেছেন। গোটা কার্শিয়াং সাব ডিভিশনে সরকারেরও তো এতজন রেঞ্জার নেই। আপনি মানুষটা সত্যিই বড় অদ্ভূৎ। এত বিত্তশালী হয়েও অরণ্যকে, প্রকৃতিকে এভাবে ভালবাসা যায়! আপনার চেয়ে বড় অরণ্যপ্রেমী আমি অন্তত কাউকে দেখিনি। বিভূতিভূষণ আপনাকে দেখলে হয়ত আরণ্যকের নতুন কোনও খন্ড লিখে ফেলতেন। অরণ্য নিয়ে বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাস বোধ হয় একশো ছাপিয়ে গেছে। কেউ কি তাঁকে আপনার কথা বলেনি! তিনিই জানেন। আমি শুধু জানি, আপনার ওই গাছগাছালি পাহাড়ের বুকে মেঘ আনে, বৃষ্টি আনে। চা বাগানের ওপর দিয়ে যখন মেঘ ভেসে বেড়ায়, তখন হৃদয়ে ঝড় তোলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ‘বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস/এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে।’

জঙ্গল থেকে একটু চায়ে ফিরি! সেই উৎকর্ষকে বুঝব, এমন গভীরতা নেই। যতবার গেছি, সঞ্জয়ের সৌজন্যে প্রতিবারই আপনার বাগানের গ্রিন টি খেয়েছি। বাজারে তার দাম নাকি কুড়ি হাজার টাকা কেজি। চমৎকার একটা রঙ, চমৎকার একটা গন্ধ। কাপের ওপর দিয়ে আলতো উড়ে যাওয়া মোলায়েম সেই ধোঁয়া! আহা! কবিতার জন্ম দিয়ে যায়। তখনই তো গাওয়া যায়, এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই। কিন্তু কেন এই চা এত মহার্ঘ্য, কেন সারা বিশ্বে সমাদৃত, তা বোঝার মতো বিদ্যেবুদ্ধি নেই। জ্যোতিবাবুর একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। উনি প্রায়ই বলতেন, ‘হাজার টাকার চায়ের সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকার চায়ের কী তফাত, আমি বুঝতে পারি না। আমার তো সব একইরকম লাগে। মনে হয় চাগুলো একই, শুধু প্যাকেটগুলো আলাদা।’ আমার অবস্থাও অনেকটা জ্যোতিবাবুর মতোই। তফাত বুঝতে পারি না। আমি নাই বা বুঝলাম। সারা বিশ্ব বুঝেছে, কুর্ণিশ জানিয়েছে মকাইবাড়িকে। তাদের অনুসারি হয়ে আমিও না হয় শ্রদ্ধায় নতজানু হলাম।

বাগানের পরতে পরতে যে যত্নের ছাপ, যে গভীর ভালবাসা লুকিয়ে আছে, তা তো অনুভব করেছি। এমন সাজানো বাগান আর কটা আছে! যখন বর্ষা আছে, গাছগুলো যখন বৃষ্টিতে স্নান করে, চরাচরজুড়ে শুধু সবুজের সমারোহ। কতবার ইচ্ছে হয়েছে আপনার মতো গাছের ওপর শুয়ে একটা ছবি তুলি। পরে মনে হয়েছে, ওটা আপনাকেই মানায়। তাই, একটি পাতাও কখনও ছিঁড়িনি। বাজারি সার নয়, প্রায় তিন দশক আগে থেকে আপনি হেটেছেন জৈব সারের পথে। ঘরে ঘরে কিনে দিয়েছেন অন্তত দেড় হাজার গরু। পরিচর্যার টাকাও দিয়েছেন। দুধ সেই শ্রমিকের, গোবরটুকু শুধু আপনার। সারা বিশ্বে যখন অর্গানিক–এর ধুম পড়েছে, আপনি সেই পথ দেখিয়েছেন তিন দশক আগে!

‘টুং, সোনাদা, ঘুম পেরিয়ে/ আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে/যখন তখন পৌঁছে যাওয়া যায়’ স্বপ্নের দার্জিলিংয়ে। যাওয়ার পথে কত চায়ের বাগান! কিন্তু অধিকাংশ বাগানেই চোখে পড়ে ধস। আপনার বাগান! সত্যিই ব্যতিক্রম। কোথাও এক ইঞ্চিও ধস নেই। এই তো সেদিন, ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল কার্শিয়াং। চারিদিকে কত ধস নামল। কই, আপনার বাগানে তো আঁচড়ও কাটতে পারল না!

আপনি নাকি ঘোড়ায় চড়ে বাগান ঘুরতেন। সে দৃশ্য কখনও দেখিনি। তবে অনেকের মুখে শুনেছি। ছবিও দেখেছি। মনে মনে সেই দৃশ্যটা কতবার ভেবেছি! পায়ে হেঁটে কীভাবে ওই চড়াই উতরাই বাগানে ঘোরেন, তাও তো দেখেছি। এই ছেষট্টি বছরেও কী নির্মেদ আপনার চেহারা! শ্রমিকদের কাছে একটা মজার গল্প শুনেছি। আপনি নাকি ভুঁড়ি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। কারও একটু ভুঁড়ি থাকলেই রেগে যান। আপনার ধারণা, ভুঁড়ি মানেই সে অলস। আর তাই ভুঁড়িওয়ালা লোক পেলেই তাঁকে পাহাড়ের অনেকটা নিচে নামিয়ে নিয়ে যান। তারপর আপনার সঙ্গে সে বেচারাকে হেঁটে উঠতে হয়। সে হাসফাস করে, আর আপনি তাকে প্রশ্ন করেন, ‘বয়স কত হল? এই বয়সেই এমন হাঁপিয়ে যাচ্ছেন!’ তারপর মাঝে মাঝেই আঁড়চোখে তাকিয়ে সেই হাঁপিয়ে যাওয়া দিব্যি উপভোগ করেন। একটা গোপন কথা তাহলে বলে রাখি। আমার মধ্যপ্রদেশটাও গত কয়েকবছরে একটু একটু করে প্রসারিত হয়েছে। পাহাড় ভালবাসলেও খাড়া পথে খুব বেশি উঠতে হলে হাপিয়ে যাই। বিশ্বাস করুন, একদিন স্বপ্ন দেখলাম, অনেক নিচের ওই থাপাথালি গ্রাম থেকে আপনি দিব্যি হেঁটে উঠে যাচ্ছেন মকাইবাড়ির দিকে। আর আমি মাঝপথেই হাসফাস করছি। তাই কি আপনার মুখোমুখি হতে পারিনি! এটাও কিন্তু একটা কারণ হতে পারে।

মালিক মানেই ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা একটা লোক। যে লোকটা শুধু হুকুম করে যায়। আপনি সেই প্রচলিত ধারনাও ভেঙে দিলেন। সাত সকালে উঠেই বাগান ঘুরতে বেরিয়ে পড়া। ফিরতে ফিরতে সেই দুপুর দুটো–তিনটে। এমন মালিক, যিনি শ্রমিকের চেয়ে দ্রুত পাতা তুলতে পারেন। এমন মালিক, যিনি মেশিন খারাপ হলে ইঞ্জিনয়ারের চেয়ে দ্রুত সারতে পারেন। এমন মালিক, যিনি তথাকথিত টি টেস্টারদের থেকে ভাল স্বাদ বোঝেন। এমন মালিক, যিনি ফরেস্ট রেঞ্জারের থেকেও ভাল গাছ ও পাখির ডাক চেনেন। মালিক মানে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ লোক, যে লোকটা সবকিছু করতে পারে। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, বাগানে শ্রমিকেরও অংশীদারিত্ব থাকুক। মুখের কথা নয়, নিজের বাগানে সেটা করে দেখিয়েছেন। শ্রমিকদের নিয়েই তৈরি আপনার পরিচালন পর্ষদ। তাও প্রায় দু দশক আগে। পাহাড়ে আপনি ছাড়া কোনও মালিক এই পথে হেঁটেছেন! আমার অন্তত জানা নেই। উন্নত লেখাপড়ার ব্যবস্থা তো আছেই। আছে চিকিৎসালয়। কোনও শ্রমিক অসুস্থ হলে শিলিগুড়ির প্রথমসারির নার্সিংহোমে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা। চিকিৎসা যত ব্যয়বহুলই হোক, এমন সহমর্মী মালিককে তাঁরা নাকি সব সময় সঙ্গে পান। বেকার যুবকদের ট্যাক্সি কেনার জন্য লোন দেওয়া! এমনটাও কখনও শুনিনি।

makaibari5

এবার আসি হোম ট্যুরিজমে। আমার না হয় সঞ্জয় আছে, সকলের তো এমন বন্ধু থাকে না! তাহলে, তারা মকাইবাড়ি আসতে পারবে না! দ্বিতীয়বারেই সঞ্জয়কে বলেছিলাম, এই বাগানের প্রেমে পড়ে গেছি। তুই যখন থাকবি না, তখন কী করব? তখনই জেনেছিলাম আপনার হোম ট্যুরিজমের কথা। হ্যাঁ, এ ব্যাপারেও আপনিই সম্ভবত পথিকৃত। নিজের খরচে বানিয়ে দিয়েছেন বেশ কিছু অত্যাধুনিক কটেজ। সেখানে সোফা থেকে কমোড, অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থাই আছে। একেবারে বাড়িতে থাকার মতোই। সেই বাড়িগুলো তুলে দিয়েছেন শ্রমিকদের পরিবারের হাতে। তারাই রান্না করে পর্যটকদের খাওয়ায়। ইচ্ছে হলে, পর্যটক নিজেও রান্না করে খেতে পারেন। এই সুযোগে নেপালি দিদি বা মাসির কাছে মো মো বানানো শিখেও নিতে পারেন। খরচও বেশি নয়। থাকা খাওয়া মিলে দুজনের খরচ বারোশো টাকার মতো। যে এসব দেখভাল করে, সেই নয়ন লামার সঙ্গেও বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ওর ফোন নম্বরও (‌৯৮৩২৪ ৪৭৭৭৪)‌ নিজের মোবাইলে সেভ করে নিয়েছি। সঞ্জয়ের নম্বর অবশ্য কাউকে দিইনি। এত ভাল পাত্র। মেয়ের বাবারা যদি হামলে পড়ে! বেচারার বিড়ম্বনার শেষ থাকবে না। তবে চুপি চুপি বলে রাখি, আপনি ওর জন্য একটা ভাল মেয়ে দেখতে পারেন। ছেলেটা নেপালি ভাষাটা চমৎকার বলে। তাই নেপালি মেয়ে হলেও আপত্তি নেই। ওর বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গ। বছরের একটা বিরাট সময় কাটে বিদেশে। কখনও চা নিয়ে বলতে ছুটে যান অক্সফোর্ডে, কখনও কেমব্রিজে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বেরোয় আপনার জীবনী। কখনও আপনাকে নিয়ে তথ্যচিত্র করতে মকাইবাড়িতে ছুটে আসে বি বি সি। আবার কখনও টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদজুড়ে আপনি আর মকাইবাড়ি। এতকিছুর পরেও এই পোড়া দেশ থেকে কতটুকু স্বীকৃতি পেয়েছেন! একটা পদ্মশ্রী! না, তাও দিতে পারেনি এই ভারতবর্ষ। অথচ, প্রায় কেউ জানে না, আট বছর আগে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল আপনার নাম। আমরা সত্যিই কুপমন্ডুক, কতটুকুই বা খোঁজ রাখি! অথচ, যদি নোবেল পেয়ে যেতেন, দেখতেন মাতামাতি কাকে বলে! তখন কে আপনার কত কাছের, তা জাহির করার হিড়িক লেগে যেত। টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আপনি, অথচ কোনও বাংলা কাগজ বা ম্যাগাজিনে আপনার ছবি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। রাজ্যের কোনও স্বীকৃতি! নিদেনপক্ষে বঙ্গভূষণ! না, তাও না। ওঁদের আর দোষ কী! আপনার কথা ওঁরা জানলে তো! একদিক থেকে ভালই হয়েছে। যাঁরা এসব পুরস্কার টুরস্কার পান, তাঁদের অনেকেরই যোগ্যতা নেই আপনার পাশে দাঁড়ানোর। তাছাড়া, সেই দাক্ষিণ্যভোগীদের সঙ্গে আপনাকে মানাতোও না। আপনি একা আছেন, বেশ আছেন। এভাবেই বনস্পতির মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকুন।

জানেন, মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়। শুনেছি, আপনার দুই ছেলের একজন থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়, অন্যজন বেঙ্গালুরুতে। বাগান সম্পর্কে তাঁদের সেই মমত্ববোধ আছে তো! আপনার অবর্তমানে এই বাগান হাতবদল হয়ে ‘বেওসায়ী’দের হাতে চলে যাবে না তো! সেদিন কী হবে এই অরণ্যের? কী হবে এই বাগানের? সেদিন কীসের টানে ছুটে যাব আমার মকাইবাড়িতে? সেদিন কি গর্ব করে বলতে পারব, তোমার বাড়ি আমার বাড়ি/মকাইবাড়ি মকাইবাড়ি!

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.