ভোটকর্মীর ডায়েরি (দ্বিতীয় কিস্তি)

(‌বেঙ্গল টাইমসের বিশেষ ফিচার। ভোটকর্মীর ডায়েরি। যাঁরা নানা সময়ে ভোটের ডিউটিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা। ভোট চলাকালীন এই সিরিজ চলবে। মাঝে মাঝেই এমন অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হবে।)

আপ্যায়নের ত্রুটি নেই

এমন আপ্যায়ন!‌ জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না। শুধু সন্ত্রাস সন্ত্রাস করে চিৎকার করলে হবে!‌ অতিথিদের প্রতি ওঁরা কত যত্নবান!‌ কী আর করব, এটুকু বলেই বাড়ির লোককে সান্ত্বনা দিতে হয়।

বছর ছয় আগের কথা। সেবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমার ভোটের ডিউটি পড়েছিল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার একটি বুথে। ব্লকের নাম বা বুথের নাম ইচ্ছে করেই বলছি না। বুঝতেই পারছেন, ছাপোষা মানুষ, এত সৎসাহস আমার নেই। তবু বেঙ্গল টাইমসে এক কর্মীর ডায়েরি পড়ে মনে হল, আমার অভিজ্ঞতাটাও জানানো দরকার।

কীভাবে ভোট হল, কটা ছাপ্পা পড়ল, সেসব তুলে ধরতে চাইছি না। আমি কিছু মজার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাইছি। কে প্রিসাইডিং অফিসার, কে ফার্স্ট পোলিং, কে সেকেন্ড পোলিং, কোনও আলাপ–‌টালাপ থাকে না। একরাতেই তারা বন্ধু, সহমর্মী হয়ে যায়। সবার মনে একটাই কথা, মানে মানে এক একটা দিন যেন পেরিয়ে যায়।

আমরাও চেয়েছিলাম, যেন ঝুটঝামেলা না হয়। তেমন হয়ওনি। হলেও আমাদের ওপর তার তেমন আঁচ পড়েনি। আমাদের বুথে গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতিতে কোনও ভোট হয়নি। সেগুলো তৃণমূল আগাম জিতে বসে আছে। কোথায় উন্নয়ন দাঁড়িয়েছিল, কে জানে!‌ তবে, জেলা পরিষদে ভোট হয়েছে। সেখানে তৃণমূল ছাড়াও বাম, বিজেপি, কংগ্রেস–‌সব দলেরই প্রার্থী ছিল।

ভোটের কথা থাক। আপ্যায়নের কথায় আসি। শুরুতেই এক তৃণমূল নেতা বলে গেলেন, কোনও চিন্তা নেই। এখানে কোনও ঝামেলা হবে না। আপনারা শুধু আমাদের একটু সাহায্য করবেন। ব্যাস।

গিয়েই বাথরুমের সমস্যা। শৌচকর্ম বা স্নানের জায়গা নেই। এই গরমে তো স্নান না করে থাকা যায় না। স্থানীয় একজনকে বললাম। তিনি বললেন, সত্যিই তো, খুব সমস্যা। তবে চিন্তা করবেন না। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নিয়ে গেলেন স্কুলের শিক্ষকদের যে বাথরুম, সেখানে। কিন্তু সেখানে তালা মারা। চাবি কার কাছে, কে আনতে যাবে। এসব আলোচনার ফাঁকেই একজন সমাজসেবক দু–‌একটা বাক্যালঙ্কার অব্যয় সহযোগে বলে উঠলেন, ধূর নিকুচি করেছে চাবির। বলেই এক লাথি মারলেন সেই দরজায়। সিনেমায় যেমন হয়!‌ চাবি খুলে গেল।

তারপর গর্বের হাসি হেসে সেই সমাজসেবক বললেন, এই তো, খুলে গেল। এটা আপনাদের। যা খুশি করুন। কিন্তু তালা যে ভেঙে গেল!‌ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমায় সমাজসেবক বলে উঠলেন, ওসব ভাববেন না। আপনারা এসেছেন ডিউটি করতে। আপনাদের দেখভাল করা আমাদের দাযিত্ব। তালার ব্যাপার স্কুল বুঝে নেবে। পয়সা ঝেড়ে ফাঁক করে দিল। একটা তালা কিনতে পারবে না?‌

দুপুরের খাওয়া দাওয়া। যাঁরা মিড ডে মিলের রান্না করেন, তাঁদেরই বলা ছিল। মেনুতে ছিল ভাত, ডাল, ডিম, আলুভাজা। কিন্তু এক তৃণমূল নেতা এসে জেদ করলেন, তাঁদের সঙ্গেই খেতে হবে। আমরা বিনীতভাবে বললাম, আমাদের তো ব্যবস্থা হয়েছে।

তাঁদের যুক্তি, আপনারা হলেন অতিথি। সারাদিন কত পরিশ্রম। আপনারা ডিমের ঝোল খেয়ে ফিরে যাবেন?‌ আমাদের অসম্মান হবে না?‌ ও সব শুনছি না স্যর, আপনাদের আমাদের সঙ্গেই খেতে হবে।

আমাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, আপনাদের মেনু কী কী?‌ জানা গেল, চিলি চিকেন আর ফ্রায়েড রাইস। সেই সহকর্মী মজা করে বলে উঠল, ভাগাড়ের মাংস খাওয়াবেন না তো?‌

সেই তৃণমূল নেতা যেন লজ্জায় পড়ে গেলেন। ছি ছি। কী যে বলেন!‌ সেই জন্যই তো এবার বিরিয়ানি বাদ। আরে বাবা, নিজেরা দাঁড় করিয়ে থেকে কাটিয়েছি। কোনও ভেজাল নেই। আর, আমরাও তো তাই খাব। একসঙ্গেই খাব।

কিন্তু একসঙ্গে সবাই খেতে গেলেও তো মুশকিল। ভোটের সময় তো আর লাঞ্চ ব্রেক থাকে না।

ওই নেতাই আশ্বস্ত করলেন, ছাড়ুন তো। ওই এক ঘণ্টা কোনও ভোট হবে না। বলেই বাইরে ঘোষণা করে দিলেন, দুটো থেকে তিনটে কোনও ভোট হবে না। ওই সময় স্যারেরা খাবেন। বলেই কয়েকজনকে বলে বসলেন, এই সব বাড়ি যা। খুব ভোট দিয়েছিস। এখন সাহেবরা খাবেন। পরে আসবি।

বলেই আমাদের নিয়ে গেলেন পাশের একটি ঘরে। ভোট বন্ধ। আমরা তাড়াহুড়ো করছি। কিন্তু তাঁদের কোনও তাড়া নেই। তাঁদের অভয়বাণী, চিন্তা করছেন কেন?‌ কেউ আসবে না। দেখছেন তো, কত পিসফুল ভোট হচ্ছে।

মনে মনে বললাম, সে কেমন পিসফুল হচ্ছে, সে তো সকাল থেকে দেখতেই পাচ্ছি। আমরা খেতে এলাম, সেই সুযোগে যদি অবাধে ব্যালট লুঠ হয়!‌ আরে বাবা, হিসেব তো সেই আমাদেরই দিতে হবে। তখন আমাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি।

সেই নেতাই আশ্বস্ত করলেন, কোনও চিন্তা নেই। আপনাদের আড়ালে কিছু হবে না। যা হবে, আপনাদের সামনেই হবে, নিশ্চিন্তে হিসেব মেলাবেন।

আসার সময় বললেন, এবার আপনাদের ঠিকঠাক আপ্যায়ন হল না। বুঝতেই পারছেন, আমরা সবাই ব্যস্ত ছিলাম। একদিন সময় করে আপনারা আসুন। আমার বাড়িতে নেমন্তন্ন রইল।

জানি, আর কখনই সেখানে যাওয়া হবে না। প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছি, এই ঢের। তবু সরকারি কর্মচারি বলে কথা। দাঁত কেলিয়ে বললাম, আপনাদের আতিথেয়তা সত্যিই অসাধারণ। প্রিসাইডিং অফিসারকে দেখিয়ে বললাম, স্যারের সঙ্গে কথা বলে, একটা ডেট ঠিক করে একদিন বেড়াতে চলে আসব।

(‌সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন)‌

(‌বেঙ্গল টাইমসের ফিচার। ভোটের ডায়েরি। ভোটকর্মীদের নানা অভিজ্ঞতা। চলবে মে মাস জুড়ে। আপনারা, যাঁরা ভোটের ডিউটিতে গিয়েছিলেন, তাঁরাও আপনাদের অভিজ্ঞতা লিখে পাঠাতে পারেন। আপনার পরিচয়টা নয়, আপনার অভিজ্ঞতাটাই বড় কথা। তাই ইচ্ছে হলে, পরিচয় গোপন রাখতেই পারেন।)‌

bengaltimes.in@gmail.com

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.