কফিহাউসের সেই গান পেয়েছে অমরত্ব। কিন্তু কফিহাউস সিরিজের আরও একটা গান গেয়েছিলেন মান্না দে। সেই গান কোথাও শোনা যায় না। মান্না দে-র জন্মদিনে হারিয়ে যাওয়া সেই গানের কথা তুলে আনলেন স্বরূপ গোস্বামী।।
প্রায় দুই দশক আগের কথা। অফিস থেকে বেরোতে রোজ রাত একটা বেজে যেত। রাতে ফেরার সময় গাড়িতেই চলত একপ্রস্থ জমজমাট আড্ডা, গান। চেনা সঙ্গী, তাই সংকোচও খুব একটা হত না। কেউ হয়ত মাঝপথে ভুলে গেল। অন্য কেউ হয়ত সেখান থেকেই ধরল। এভাবেই চলত গানের আসর। কখনও মান্না দে, কখনও হেমন্ত, কখনও সুমন। আর চিরন্তন রবি ঠাকুর তো ছিলেনই।
এক রাতে একটু তাড়াতাড়ি বেরোনোর সুযোগ পেলাম। তাড়াতাড়ি মানে রাত এগারোটা। সামনের সিটে বসলেন শমীন্দ্রদা, অর্থাৎ কালচারাল ডিপার্টমেন্টের শমীন্দ্র রায়চৌধুরি। উনি সচরাচর এত রাত পর্যন্ত থাকেন না। কিছুটা আগেই বেরিয়ে যান। তাই শমীন্দ্রদার সঙ্গে তার আগে কখনও এক গাড়িতে ফেরা হয়নি। ভারী চেহারা, গম্ভীর ভাব। টুকটাক কথা হলেও বেশি কথা বলতে কিছুটা সংকোচই হত।
আজকালের অফি্স তখনও ঝাঁ চকচকে সেক্টর ফাইভে উঠে আসেনি। আমহার্স্ট স্ট্রিটের লাহাবাড়িই ছিল অফিস (৯৬, রাজা রামমোহন সরণি)। সেখান থেকেই তিনটে সিফটে শহরের নানা প্রান্তের গাড়ি ছাড়ত। আমি উঠতাম সাউথের গাড়িতে। অর্থাৎ, আমার সঙ্গীরা কেউ টালিগঞ্জের, কেউ কুঁদঘাটের, কেউ বেহালার। সেই রাতে শমীন্দ্রদা বসেছিলেন সামনের সিটে। তিনি নামবেন বেহালায়। পেছনের সিটে, আমার পাশেই ছিলেন সতীর্থ ক্রীড়া সাংবাদিক সৌরাংশু দেবনাথ। ও গানের খুব অনুরাগী। প্রায়ই বলত, একটা গান হয়ে যাক। সেদিনও বলল। কিন্তু বাথরুম সিঙ্গারের গলা নিয়ে শমীন্দ্রদার সামনে গান গাইতে কিছুটা সঙ্কোচই হচ্ছিল। বললাম, আজ থাক, অন্যদিন হবে।
শমীন্দ্রদা বললেন, সবাই যখন বলছে, তখন হয়েই যাক। আমি বললাম, আপনার ভাল লাগবে না। উনি সাহস দিয়ে বললেন, ‘আরে বাবা, তুমি তো স্টেজে বা ফিল্মে গাইছ না। যেমন পারো, তেমন গাও।’ শুরুতে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত ধরলাম। শেষ হতেই বললেন, ‘তোমার গানের গলাটা তো বেশ। আরেকটা হোক।’
তখন কিছুটা সাহস বেড়ে গেছে। দ্বিধাও অনেকটা কেটেছে। বললাম, রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, একটু অন্যরকম গান শোনাই। তারপরই ধরলাম হারিয়ে যাওয়া একটা গান, ‘স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফিহাউসের, আজ আর নেই। জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই, আজ আর নেই।’ একপাশে সৌরাংশুর কথা তো আগেই বলেছি (এখন দুজনের কর্মক্ষেত্র আলাদা হলেও বন্ধুত্ব অটুট। যার সঙ্গে এখনও সুযোগ পেলেই অজানা পাহাড়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ি)। আরেক পাশে কে, ঠিক মনে পড়ছে না। তারা হয়ত ভাবছে, নির্ঘাত ভুল গাইছি।
গোটা গানটা শেষ হওয়ার পর শমীন্দ্রদার চোখেমুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি। থরথর করে কাঁপছেন। কিছুটা যেন বাকরুদ্ধ। বাকি দুই সঙ্গী তখনও ব্যাপারটা সেভাবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিছুটা সামলে নিয়ে শমীন্দ্রদা বললেন, এই গান তুমি কোথায় শুনলে? পুরোটা মনে আছে ! আমারই তো মনে ছিল না।’ বাকিরা তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তারা জিজ্ঞেস করছে, এটা কার গান? আমি বললাম, এটা শমীন্দ্রদার লেখা গান, মান্না দে গেয়েছেন।’
শমীন্দ্রদা এমন মানুষ, নিজের কথা নিজের মুখে কখনই বলতেন না। তাই গোটা অফিসে খুব কম লোকই জানত, তাঁর লেখা গান মান্না দে গেয়েছেন। গানটা বেশ বড়। পুরোটা গাইতে পারব কিনা, নিজের মনেই কিছুটা সংশয় ছিল। না, সেদিন স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। শমীন্দ্রদার সামনে তাঁর গান পুরোটা গাইতে পেরে বেশ আনন্দই পেয়েছিলাম। এতদিন পর তাঁর লেখা হারিয়ে যাওয়া একটা গান অনুজ সহকর্মীর মুখে শুনে তাঁরও নিশ্চয় ভালই লেগেছিল।
আপাত রাশভারী শমীন্দ্রদার কণ্ঠে ঝরে পড়ল আক্ষেপ, ‘এমন একটা গান। মানুষের কাছে পৌঁছল না। মানুষ গানটার কথা জানতেও পারল না। এই প্রথম গানটা কেউ গেয়ে শোনালো।’ তার আগে এই গানটা অনেককেই গেয়ে শুনিয়েছি। সবাই শুনে একটা কথাই বলেছে, এটা কার গান? বলেছি, মান্না দের। উত্তর এসেছে, ‘কই, এটা আগে শুনিনি তো!’ এভাবেই একটা গান কীভাবে নিঃশব্দে হারিয়ে গেল! অথচ, কালজয়ী হয়ে ওঠার সবরকম উপাদানই ছিল গানটার মধ্যে। সেই রাতে আর কথা হয়নি। পরে শুনেছিলাম, সেই রাতেই বাড়ি ফিরে শমীন্দ্রদা ফোন করেছিলেন সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষকে। বলেছিলেন, ‘সুপর্ণ আমাদের ওই গান হারিয়ে যায়নি। আজও বেঁচে আছে। আমার অফিসের এক সহকর্মী আমাকে পুরো গানটা শুনিয়েছে।’
কফি হাউস সিরিজের বিখ্যাত গানটাও সুপর্ণকান্তির সুর। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। কিছুটা জোর করেই আড্ডা নিয়ে একটা গান লিখিয়ে নিয়েছিলেন সুপর্ণ। পুত্রসম গীতিকারের এই আবদার ফেলতে পারেননি গৌরীপ্রসন্ন। গানটা লেখা হল। প্রাণ ঢেলে তাতে সুর করলেন নচিকেতা ঘোষের সুযোগ্য পুত্র। তখন তিনি সদ্য স্নাতক হয়েছেন। গানটা বেশ মনে ধরে গেল মান্না দে-র। সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, রেকর্ড করবেন। তারপর কী হল, সে এক ইতিহাস। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল সেই গান। দেশে-বিদেশে মান্না দে যেখানেই গাইতে যান, এই গানের আবদার আসবেই। আড্ডাপ্রিয় বাঙালির নস্টালজিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে গেল গানটা।
কিন্তু একটা তথ্য বাঙালি হয়ত শুনলে বিশ্বাসও করবে না। সেটা হল, কফিহাউস গাওয়ার আগে বা পরে মান্না দে নিজে কখনও কফিহাউস যানননি। এমনকি কফিহাউস সিরিজের দ্বিতীয় গানটার পরেও যাননি (গিয়েছিলেন গানটা রেকর্ড হওয়ার দু দশকরও পরে, একটি টেলি ছবির শুটিংয়ে)। এমনকি এই দুই গানের সুরকার সুপর্ণকান্তিও যাননি। প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, ‘মান্না দে যদি নাই গিয়ে থাকেন, কী আসে যায়। না গিয়েও যদি ওইরকম গান গাওয়া যায়, মন্দ কী! আমি নিজেও কিন্তু কখনও কফিহাউসে যাইনি। কফিহাউসের গান বাঙালি মনে রেখেছে, ওই গান শুনে মানুষ কফি হাউসে যায়, এটাই আমার তৃপ্তি।’
প্রথম গানের ঠিক তেইশ বছর পর। সুপর্ণকান্তির মনে হল, কফিহাউসের সেই চরিত্রগুলো কেমন আছে? তেইশ বছর পর কোথায় আছে সুজাতা? এতদিনে নিশ্চয় তার মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। অমলের লেখা কবিতাগুলোরই বা কী হল? মঈদুল কি এই দেশেই আছে? আর নিখিলেশ? ঘুরপাক খেতে লাগল চরিত্রগুলো। কথাটা পাড়লেন মান্না দে-র কাছে। মান্না দে-ও খুব উৎসাহী। কিন্তু এই গান লিখবেন কে? তখন তো গৌরীপ্রসন্ন নেই। এমনকি মান্না দের-র বহু জনপ্রিয় গানের গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ও নেই। তাহলে, কাকে বলা যায়? বেশ কয়েকজন পরিচিত গীতিকারকে বলা হল। কিন্তু কিছুতেই মনে ধরছিল না সুরকারের। এমনকি মান্না দের-ও। শেষমেষ শমীন্দ্র রায়চৌধুরির লেখা গানই বেছে নেওয়া হল। তখন সুপর্ণকান্তি দেশে ছিলেন না। আমেরিকায় ছিলেন। ফলে, ই মেলে, রোমান হরফে গান টাইপ করে পাঠাতে হয়েছিল গীতিকারকে।
সুর হওয়ার পর দেখা গেল, মান্না দে দেশে নেই। আবার অনন্ত অপেক্ষা। ঘসামাজা করে, আরও পরিমার্জিত আকারে, পরম যত্ন নিয়ে গানটা তৈরি করলেন সুপর্ণকান্তি। মান্না দে এই গান পেয়ে শিশুর মতো লাফিয়ে উঠলেন। আশির দরজা পেরিয়ে যাওয়া কণ্ঠে গাইলেন কফিহাউস টু।
শুরুর দিকে বেশ ভালই আলোড়ন ফেলেছিল। এমনকি মিউজিক ওয়ার্ল্ডে ওই ক্যাসেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রাইম মিউজিকের কর্ণধার ইন্দ্রনীল সেন বলেই ফেললেন, ‘এটা দারুণ গান হয়েছে। আমি কিন্তু এটার রিমেক করব। এখনই আগাম মান্নাদার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাখলাম।’ কয়েক মাস যেতে না যেতেই বাজার থেকে ক্যাসেট হাওয়া। এমন একটা গান নিঃশব্দে হারিয়ে গেল।
এত এত এফ এম চ্যানেল। চব্বিশ ঘণ্টা ধরে অহরহ গান বেজেই চলেছে। অথচ, এফ এমে এই গানটা কোনওদিন শুনেছি বলে মনে হয় না। প্রসঙ্গটা উঠতেই কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে গেলেন সুপর্ণকান্তি। নিজের ইউ বি আই সদর দপ্তরে প্রথমেই জানতে চাইলেন, সত্যি করে বলুন তো, গানটা কেমন লেগেছে ?’ কিছুটা আমতা আমতা করে বললাম, ‘গৌরীপ্রসন্নবাবুর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলছি, দ্বিতীয়টা আরও বেশি করে মনকে ছুঁয়ে যায়।’ কথাগুলো তাঁকে খুশি করার জন্য নয়। নিজের বিশ্বাস থেকেই বলেছিলাম। সুপর্ণকান্তি বললেন, ‘একেবারে ঠিক কথা বলেছেন। আমিও তাই মনে করি। আমার জীবনের সব গান একদিকে, এই গানটা আরেক দিকে। দেড় বছর ধরে, সব কাজ বন্ধ রেখে গানটাকে তৈরি করেছি। মান্না দে নিজেও খুব যত্ন নিয়ে গানটা গেয়েছিলেন। কিন্তু এই গানটা মানুষের কাছে পৌঁছলই না। এটা নিয়ে একটা চাপা যন্ত্রণা তাঁর মনেও থেকে গিয়েছিল। যখনই দেখা হত, এই গানটার কথা বলতেন।’
মুদ্রার দুই পিঠে দুই কফিহাউস। একটা গান পেয়েছে অমরত্ব। আরেকটা গান তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অন্ধকারে। সাহিত্য, সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় বিচারক নাকি মহাকাল। অনেক জনপ্রিয় গান তলিয়ে যায় মহাকালের গর্ভে। আবার অনেক লুকিয়ে থাকা গান, আবার নতুন করে প্রাণ পায়, অনেক বছর পর। বাংলা গানের বিবর্তনের স্রোতে দুরকম নজিরই আছে।
আক্ষেপের পাশাপাশি, অপেক্ষাও থাকুক। থাকুক স্বপ্ন। একদিন যদি এই গান আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়! আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি, কার তাতে কী?
(লেখাটি বেঙ্গল টাইমসে আগেও প্রকাশিত হয়েছে। মান্না দে–র জন্মদিনে তা আবার ফিরিয়ে আনা হল। অনেকেই হয়ত পড়েননি, মূলত তাঁদের কথা ভেবে। যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা না হয় আবার পড়ুন। )