দ্বিধাদ্বন্দ্ব সরিয়েও ‘‌জাস্টিস’‌ চাই

উইশফুল থিঙ্কিং। অর্থাৎ, আমি কী চাই। ভোটে কে জিতবেন, কে হারবেন, তা ঠিক করবেন জনতা। কিন্তু কার জয় চাই, কার পরাজয় চাই। কেন?‌ এই নিয়েই বিশেষ বিভাগ। এবার জাস্টিস অভিজিৎ গাঙ্গুলি। তাঁকে নিয়ে লিখলেন রক্তিম মিত্র।।

 

একজন মানুষের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে। তিনি জাস্টিস অভিজিৎ গাঙ্গুলি। এখন তিনি ‘‌জাস্টিস’‌ নন। কিন্তু কী করবেন, এতদিনের অভ্যেস!‌ তাঁর নামের আগে এই শব্দটাই ব্যবহার করে এসেছি। তিনি পদত্যাগ করুন আর যাই করুন, এই ‘‌জাস্টিস’‌ শব্দটা আপনাআপনিই এসে যায়।

একটা কথা অকপটেই স্বীকার করা যাক। দু’‌বছর আগেও তাঁকে চিনতাম না। তাঁর নামটাও কখনও শুনিনি। আইনজীবীরা হয়তো চিনতেন। কিন্তু আমি চিনতাম না। হতে পারে, এটা আমার অজ্ঞতা। সত্যিই তো, কলকাতা হাইকোর্টে কত বিচারপতি আছেন। কত বিচারপতি ছিলেন। কজনকেই বা আমরা চিনি!‌ তেমনই তাঁকেই চিনতাম না।

আরও একটা কথা বলে নেওয়া ভাল। আমি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। আমি কোনওকালেই এসএসসি দিইনি। এমন একটা বিষয় নিয়ে পড়েছি, যেটা এসএসসি–‌র আওতাতেও আসে না। বলতে পারেন, আমার এসএসসি দেওয়ার যোগ্যতাও ছিল না। তাই আমি বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থী নই। আগামীদিনের চাকরিপ্রত্যাশীও নই। আমার পরিবারের কেউও এসএসসি দেয়নি। ফলে, সেই কারণে তাঁর প্রতি আলাদা দুর্বলতা থাকারও কথা নয়।

কিন্তু কিছু কিছু মানুষকে ভাল লেগে যায়। সেই ভাল লাগার পেছনে যুক্তি যেমন থাকে, আবেগও থাকে। মনে হয়েছিল, এই মানুষটা সৎ। এই মানুষটা অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। এই মানুষটা চাইলেই একটু আপস করতে পারতেন। আরও সাচ্ছন্দ্যে বাকি জীবনটা কাটাতে পারতেন। ঝুটঝামেলায় না জড়িয়ে রুটিন কাজটাই করতে পারতেন। কিন্তু মানুষটা একটা ছাপ রেখে যেতে চান। দীর্ঘসূত্রিতা থেকে বিচারবিভাগকে বের করে আনতে চান।

তাই কখনও তিনি তদন্তকারি সংস্থাকেও তিরষ্কার করছেন। কখনও তদন্তে তাড়া দিচ্ছেন। কখনও এমন মন্তব্য করে বসছেন যা সারাদিনের শিরোনাম হয়ে থাকছে। কখনও টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়ে বসছেন। কাজগুলো ঠিক না ভুল, আমি জানি না। কিন্তু মানুষটার মধ্যে একটা ভরসা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমার মতো অনেকেই হয়তো পেয়েছিলেন। কথাবার্তা শুনে মনে হল, মানুষটার ভেতর পড়াশোনা আছে। পড়াশোনা মানে ডিগ্রি নয়, দারুণ ইংরাজি বলা নয়। আমার মতো লোক পড়াশোনা বলতে বোঝে, যেগুলো তাঁর সিলেবাসে ছিল না, যেগুলো তাঁর না পড়লেও চলত, সেগুলো পড়েছেন কিনা।

আইনের এত মারপ্যাঁচ বুঝি না। এটুকু বুঝতাম, শাসকদল তাঁকে শায়েস্তা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কখনও তাঁর রায় ডিভিশন বেঞ্চে, সুপ্রিম কোর্টে আটকে যাচ্ছে। এবং এই আটকে যাওয়ার পেছনে কতটা আইনি ব্যাখ্যা আর কতটা অন্যরকম বোঝাপড়া, তা নিয়েও মনে প্রশ্ন জাগত। কখনও হতাশ হয়ে পড়তেন। তিনিও তো মানুষ। হতাশা আসাটাই স্বাভাবিক। বুঝতে পারতাম। তাঁর কষ্টটা অনুভব করতে পারতাম। হঠাৎ করে শুনলাম, সেই মানুষটা রাজনীতিতে আসছেন। ভোটে দাঁড়াবেন। তাও আবার বিজেপির হয়ে।

খুশি হওয়া উচিত নাকি হতাশ হওয়া উচিত?‌ স্বাগত জানানো উচিত নাকি সমালোচনা করা উচিত। এই নিয়ে বেশ দ্বিধাই ছিল। তাঁকে যেটুকু চিনেছি, বিজেপির চিন্তাভাবনার সঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনা বিশেষ মেলে না। তিনি বাম শিবিরে এলে হয়তো মনেপ্রাণে আরও বেশি খুশি হতাম। কিন্তু এটাও তো ঠিক, এই মুহূর্তে যা অবস্থা, তাতে বামেদের হয়ে বা বাম সমর্থিত প্রার্থী হয়ে সেই চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা হয়তো সহজ হত না। তাই হয়তো বিজেপি শিবিরে নাম লিখিয়েছেন।

তিনিও বিশ্বাস করতেন, সিবিআই–‌ইডি ইচ্ছে করেই তদন্তের গতি শ্লথ করছে। তিনিও বিশ্বাস করতেন, কেন্দ্রীয় এজেন্সি আসল মাথাদের আড়াল করার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে কোর্টরুমে বলেও ফেলতেন। চেয়ারে বসে সবটা বলা যায় না। কিন্তু তিনিও নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করতেন, ওপর থেকে শীতঘুমে যাওয়ার বার্তা না দেওয়া হলে সিবিআইয়ের বাবার ক্ষমতা ছিল না তদন্তের গতিকে এভাবে শ্লথ করার। দিল্লির আশীর্বাদের অদৃশ্য হাত মাথায় না থাকলে কারও হিম্মৎ ছিল না সিবিআই জেরা থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে একঘণ্টা ভাষণ দেওয়ার।

কিন্তু সেই দলেই কিনা তিনি নাম লেখালেন!‌ একটা খচখচানি থেকেই যাবে। তারপরও চাইব, এই মানুষটা জিতুন। কোন দলের এমপি হলেন, সেটা না হয় ভুলে যাব। দু একটা বেফাঁস কথাও বলছেন। খারাপ লাগছে। কিন্তু তাঁর এই মাঠে ময়দানে রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা নেই, এটা ভেবে না হয় উপেক্ষা করব। তিনি বিজেপিতে গেছেন বলেই ধান্দাবাজ, লোভী — এই শব্দগুলো বলতে পারব না। রাজনীতিতে ভাল মানুষ কমে আসছে। রাজনীতিতে অভিজিৎ গাঙ্গুলিরা থাকবেন না তো কি কুন্তল, শান্তনু, শাজাহানদের মতো দুর্বৃত্তরা থাকবে?‌

দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। তারপরেও চাইব, তমলুক থেকে এই মানুষটা জিতুন। এই মানুষটার জেতা খুবই দরকার।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.