দেবের সৌজন্য মেকি নয়, বেশ আন্তরিক

সৌম্যজিৎ চৌধুরি

দেব বলতেই লোকে বোঝে পাগলু, চ্যালেঞ্জ টু, মন যে করে উড়ুউড়ু, পরান যায় জ্বলিয়া রে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আবার দেব বলতে বুঝি বুনোহাঁস, চাঁদের পাহাড়, সাঁঝবাতি, প্রজাপতি ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, সেই দেব নিজেকে ভাঙছেন, গড়ছেন। এই বয়সে এসে বুঝেছেন, একটা সময় যে ছবিগুলো করেছেন, এখন আর সেগুলো তাঁকে মানায় না।

দেখতে দেখতে সেই দেবের দশ বছর এমপি থাকা হয়ে গেল। এবার তৃতীয়বারের জন্য দাঁড়িয়েছেন। অন্তত ঘাটালের যা সমীকরণ হয়তো জিতেও যাবেন। এমপি হিসেবে তিনি কতখানি সফল?‌ তাঁকে ব্যর্থ বলাই যায়। অনেক পরিসংখ্যান দেওয়া যায়। তিনি সংসদে কদিন হাজির থেকেছেন, কটা প্রশ্ন করেছেন, কতবার বিতর্কে অংশ নিয়েছেন, এইসব পরিসংখ্যানগুলো নিশ্চিতভাবেই তাঁর পক্ষে যাবে না। আবার তিনি এলাকায় কতখানি সময় দিয়েছেন বা কত কেন্দ্রীয় প্রকল্প চালু করতে পেরেছেন, এগুলোও তাঁর বিপক্ষেই যাবে।

কিন্তু তারপরেও বলব, এখন বাংলার যা পরিস্থিতি, তাতে তাঁকে অনকটাই ব্যতিক্রমী মনে হয়। সৌজন্যের প্রতীক বলেও মনে হয়। এই ঘাঁটাল থেকেই আগে সাংসদ ছিলেন গুরুদাস দাশপ্ত। তাঁরও আগে ছিলেন গীতা মুখার্জি। তাঁদের সঙ্গে দেবের তুলনা করব, এতখানি মূর্খ আমি নই। তাঁরা নমস্য। সাংসদ হিসেবে তাঁদের যা ভূমিকা, তার এক হাজার মাইলের মধ্যেও দেবকে আনা যায় না। কিন্তু তারপরেও বলব, এই ছেলেটিকে বেশ লাগে। এই ছেলেটি জিতলে খারাপ লাগবে না, বরং ভালই লাগবে।

আসলে, এই রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যখন দিনের পর দিন কলুষিত হয়ে চলেছে, তখন দেব অন্তত নিজের সৌজন্য, ভদ্রতা বজায় রেখেছেন। রাজনীতি করতে গেলে, এমনকী তৃণমূল করতে গেলেও, ভদ্রতা বজায় রেখেও তা করা যায়, দশ বছরে এটুকু অন্তত প্রমাণ করতে পেরেছেন। মনে পড়ছে, দশবছর আগের কথা। তখন বিজেপি সেভাবে লড়াইয়ে নেই। তাঁর মূল প্রতিপক্ষ সিপিআইয়ের সন্তোষ রানা। দেব ফোন করে সন্তোষ রানাকে বললেন, ‘‌স্যার আপনার বাড়িতে চা খেতে যেতে চাই।’‌ সন্তোষবাবু স্বাগত জানালেন। সেদিন দেব এসেছিলেন। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘মানুষ হিসেবে আপনি শ্রদ্ধেয়। ‌আমি আপনাকে কোনও ব্যক্তিগত আক্রমণ করব না। আপনার প্রতি এই সম্মান সম্মান বজায় রাখব। যদি আমার কর্মীরা কোনও খারাপ আচরণ করে, তাহলেও আপনি আমাকে জানাবেন।’‌ দেবের এই সৌজন্য সত্যিই ভাল লেগেছি। এবং সেটা যে নির্বাচনী গিমিক ছিল না, গত দশ বছরে দেব সেটা বারেবারে প্রমাণ করেছেন। অন্তত তাঁর দিক থেকে বিরোধীদের প্রতি কোনও অসম্মান জনক ভাষণ বা উস্কানি আসেনি। বিরোধীদের সম্মান দেখানোয় কোনও কার্পণ্য দেখা যায়নি। তৃণমূলে থেকে এটাও কিন্তু কম ব্যাপার নয়।

মিঠুন চক্রবর্তী বিপক্ষ শিবিরের, এটা জেনেও মিঠুনের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সিনেমায় যেমন পিতা–‌পুত্র ছিলেন, বাস্তবেও পিতা–‌পুত্র সম্পর্কের সেই মর্যাদা বজায় রেখেছেন। তাঁর দলনেত্রী মিঠুনকে আক্রমণ করলেও তিনি গলা মেলাননি। বরং, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন, এই জাতীয় মন্তব্য তিনি সমর্থন করেন না। আবার বলছি, তৃণমূলে থেকে এতখানি বলাও কিন্তু খুব সহজ নয়। সাংসদ থাকার জন্য, টিকিট পাওয়ার জন্য লোকে কতকিছুই না করে। কিন্তু দলের কিছু আচরণে দেবের মনে হল, তিনি এবার আর লড়াই করবেন না। সরে দাঁড়াবেন। আন্তরিকভাবেই সরে যেতে চেয়েছিলেন। এবং এটাও দর বাড়ানোর নাটক ছিল না। বলা যায়, তৃণমূলই ধরে বেঁধে আবার তাঁকে দাঁড় করাল। বিপক্ষ প্রার্থী হিরণ তাঁকে নানা কুরুচিপূর্ণ আক্রমণ করে গেলেন। দেব কিন্তু সতীর্থকে কোনও পাল্টা আক্রমণের রাস্তায় গেলেন না। দিন কয়েক আগে একটা ভিডিও এল। বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে দেব বেরোচ্ছেন। একদল ‘‌জয় শ্রীরাম’‌ বলে চিৎকার শুরু করে দিলেন। তাঁর নেত্রী হলে নির্ঘাত রেগেই যেতেন। কিন্তু দেব এতটুকুও রাগলেন না। হাঁসিমুখে এগিয়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। বেচারা রামভক্ত হনুমান!‌ তার বিপ্লব কোথায় যে হারিয়ে গেল!‌

টুকরো টুকরো কিছু মুহূর্ত। একজন মানুষকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। তাই সাংসদ হিসেবে দেব মোটেই সফল নন, একদিকে এমন দাবিও করব। আবার চাইব, সুস্থ রাজনীতির স্বার্থে দেবরা জিতে আসুন। ভদ্রতা, সৌজন্য— এগুলোও জরুরি। এই পাতাকাটা না হয় দেবের হাতেই থাক।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.