বিপ্লব মিশ্র
এবার ভোটে আমার প্রিয় প্রার্থী কে? বিয়াল্লিশটি কেন্দ্র। এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা জিতলে ভাল লাগবে। কিন্তু এক নম্বরে রাখব সৃজন ভট্টাচার্যকে। নামটার মধ্যেই অদ্ভুত এক সৃজনশীলতার অনুভূতি। অদ্ভুত এক ক্যারিশমা; ভদ্রতায়, সৌজন্যে, ব্যবহারে। এই সৃজনকে হঠাৎ চিনছি, এমন নয়। মূলস্রোত মিডিয়ায় এঁদের কথা সেভাবে তুলে ধরা হয় না। তাই বছর পনেরো আগে যদি সৃজন যাদবপুরের প্রার্থী হতেন, আমি সুদূর জঙ্গলমহলে বসে তাঁর কতটুকু খবরই বা পেতাম। কিন্তু এখন মূলস্রোত মিডিয়ার থেকেও শক্তিশালী সোশ্যাল মিডিয়া। তাই যার যেটা নিয়ে আগ্রহ, সেটা নিয়ে খবর ঠিক পাওয়া যায়। সেই কারণেই আমি সৃজনকে চিনি। তাঁর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমি পরিচিত।
হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা কোনও নেতা নন। ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা উচ্চশিক্ষিত রুচিশীল পরিবারের উচ্চশিক্ষিত বাগ্মী প্রাণবন্ত উচ্ছ্বল তরুণ। যাঁর সামনে অনেক উজ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি থাকলেও সেসব হেলায় ছেড়ে এসেছেন। বেছে নিয়েছেন হোলটাইমারের কঠিন, দুর্গম জীবন। তাঁর যা যোগ্যতা, তাঁর যা লেখাপড়া, তাতে কী হতে পারতেন, তা নিয়ে কোনওদিন আক্ষেপ করতে শুনিনি। বরং, এই আত্মসর্বস্বতার যুগেও ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ’ তাড়ানোর কাজটা বেছে নিয়েছেন হাসিমুখেই।
অনেক বামপন্থীকে দেখেছি, যাঁদের কথাবার্তা মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। কী বলছেন, কী বলতে চাইছেন, কিছু বোঝাই যায় না। কিন্তু সৃজনের প্রতিটি বাক্য আমি বুঝতে পারি। নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারি। মনে হয়, এই ছেলেটি তো আমার কথাই বলছে। ছোট থেকে শিখে আসা চেনা সংলাপ নয়। একেবারে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কথা। ভারতের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, পর্যাপ্ত রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন আপন ভোলা বাচ্চা ছেলে মার্কা হাসির তরুণকে মনে হয় যেন পাশের বাড়ির ছেলে, কিন্তু এমন কথা বলে যেন আমার বাড়িরই কথা। সর্বত্র যেখানে ভাষা সন্ত্রাস, সেখানে তিনি যেন ওয়েসিস। মনে হয়, কত কঠিন কথা, কত সহজ করে বলছেন। কোনও প্রশ্নেই রেগে যাচ্ছেন না। কোনও চাপা ঔদ্ধত্য বা অহঙ্কারের ছিটেফোঁটাও নেই। সবসময় একটা ভুবনভোলানো হাসি। আর সেই হাসিটাও মেকি নয়, বেশ আন্তরিক। আবার কোথাও দ্বিমত পোষণ করছেন, কিন্তু কী অদ্ভুত শালীনতায় মোড়া। ভিন্ন মত মানেই অন্যকে ছোট করা নয়, উল্টোদিকে মানুষটাকে অসম্মান করা নয়। শ্রদ্ধা রেখেও ভিন্ন মতের, ভিন্ন পথের পথিক হওয়া যায়। কারও সম্পর্কে কোনও কটু কথা না বলে নিজের যোগ্যতাটুকু তুলে ধরা।
বছর তিনেক আগে, তাঁকে পাঠানো হয়েছিল সিঙ্গুরে। অন্য কোনও কেন্দ্রেও হয়তো দেওয়া যেত। কিন্তু সিঙ্গুরটা ছিল প্রতীকী। এই সিঙ্গুরকে ঘিরেই বিকশিত হয়েছিল শিল্পের স্বপ্ন। এই সিঙ্গুরেই সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু। তাই সেই সিঙ্গুর থেকেই নতুন স্বপ্নের বার্তা। জানতাম, লড়াইটা কঠিন। কিন্তু সেবারেও মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম, সৃজন জিতুন। বিধানসভায় একটা ঝকঝকে তরুণ মুখ আসুক। এত কাদা ছোড়াছুড়ির আবহে তিনি হয়ে উঠতে পারতেন একঝলক টাটকা বাতাস।
পেরিয়ে গেছে আরও তিনটে বছর। এই তিনটে বছরে সৃজন আরও পরিণত। আরও বেশি করে পরিচিত। কিন্তু মুখের হাসি একইরকম ভুবন ভোলানো। শিষ্টাচার, সৌজন্য একইরকম। বড় ভাল লাগে ছেলেটিকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যখনই তাঁর সম্পর্কে কোনও নোটিফিকেশন আসে, সব কাজ ফেলে সেই ভিডিও দেখে ফেলি। তাঁর কথা শুনি। মন ভাল হয়ে যায়। মনে হয়, এই ছেলেটিই তো আমার মিছিলের সেই মুখ। এই ছেলেটিই তো এই শূন্যে নেমে যাওয়ার পর আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। এই সৃজন গণতন্ত্রের পীঠ স্থানে গেলে আমার মতো গণতন্ত্রের হাসিও যে চওড়া হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চারপাশে অসুস্থ রাজনীতির আবহে এক ঝলক টাটকা বাতাস আমাদের এই সৃজন। যাদবপুরের মাটি অনেক চেনা হিসেব উল্টে দেয়। বছরখানেক আগে একটা স্লোগান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, লাঠির মুখে গানের সুর, পথ দেখাল যাদবপুর। জানি, পরিস্থিতি প্রতিকূল। জানি, ভোটের অঙ্ক আবেগ মেনে চলে না। তবু, মন থেকে চাই, এবারও পথ দেখাক যাদবপুর।
আমি না হয় বাম সমর্থক। আমি সৃজনের জয় চাইব, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি সৃজন জিতে যান, তামাম যাদবপুরের তৃণমূল বা বিজেপি কর্মীরাও কি মনে মনে খুশি হবেন না! তাঁরা হয়তো লাল আবির খেলবেন না। কিন্তু মনে মনে তাঁরাও নিশ্চিতভাবেই বলবেন, হ্যাঁ, এই এলাকা থেকে সবথেকে যোগ্য ছেলেটাই সংসদে গেছে। সৃজনকে তাঁদের প্রতিনিধি ভেবে মনে মনে তাঁরাও নিশ্চয় গর্বিত হবেন।