আদালতও আগে আসল মাথা খুঁজুক

রক্তিম মিত্র

এক ধাক্কায় পঁচিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি যাওয়ার নিদান। অনেকের কাছেই বৈপ্লবিক এক রায়। অনেকেই দেখছি উল্লসিত। কিন্তু আমি ঠিক ততখানি উল্লসিত হতে পারছি না।

এই পর্যন্ত পড়ে অনেকেই বলতে শুরু করে দেবেন, এ ব্যাটা নির্ঘাত তৃণমূলের দালাল। আসলে, সহজেই একটা তকমা এঁটে দেওয়া আমাদের অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সোশ্যাল মিডিয়ার ফাট ফুড জমানায় তা মহামারীর চেহারা নিয়েছে। তাই একটু দ্বিমত দেখলেই শত্রু শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।

আদালত আইনিভাবে হয়তো সঠিক রায় দিয়েছে। হয়তো এমন রায়ের নজির অতীতে রয়েছে। কিন্তু যাঁরা অন্যায় উপায়ে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদেরই সবথেকে বড় ভিলেন মানতে আমি অন্তত রাজি নই।

কোর্ট নিজেই স্বীকার করে নিয়েছে, এটা সংগঠিক অপরাধ। একেবারে ওপর তলা থেকে নির্দেশেই এমনটা হয়েছে। সেই মাথার কাছে পৌঁছনো কি সত্যিই খুব কঠিন ছিল?‌ না, সেই মাথা পার্থ চ্যাটার্জি নন। সেই মাথা পর্ষদের কোনো কর্তাও নন। তাঁরা নেহাতই চুনোপুঁটি। অনেকে মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীকে দায়ী করছেন। তাঁদের নৈতিক দায় নিশ্চয় আছে। কিন্তু তাঁরাও কখনই মূল মাথা নন। তাহলে কে?‌

এটা যিনি এখনও বুঝতে না পারছেন, দোহাই তিনি আর রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা বলবেন না। বলতেই পারেন, প্রমাণ কোথায়?‌ একটা কথাই বলতে হয়, প্রমাণ নেই কেন?‌ সবাই জানেন, আসল নাটের গুরু কে?‌ তারপরেও সিবিআই, ইডি জানল না!‌ তাঁরা কোনও প্রমাণ পেল না?‌ আমার তো মনে হয়, এই তদন্তকারীদের আগে জেলে ভরা উচিত। যাঁদের প্রমাণ জোগাড় করার কথা, তাঁরা যদি প্রমাণ লোপাট করতে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে প্রমাণ পাওয়া যাবে কী করে?‌

সিবিআই মাঝে মাঝেই আদালতে কাঁদুনি গায়, রাজ্য পুলিশ সহযোগিতা করছে না। এই যুক্তিটা যখন শুনি, তখন মনে হয়, এদেরই গাছে বেঁধে পেটানো দরকার। রাজ্য পুলিশ তদন্তে সহযোগিতা করছে না, এটা এত বছর পর বুঝতে পারলেন!‌ রাজ্য পুলিশ সহযোগিতা করবে না, উল্টে বাধা দেবে বলেই তো সিবিআই বা ইডি–‌কে তদন্তভার দেওয়া।

যিনি আসল পান্ডা, তিনি যতই ধুরন্ধর হোন, তিনি যতই প্রমাণ লোপাট করুন, সেগুলো যদি সিবিআই খুঁজে বের করতে না পারে, তাহেল কীসের সিবিআই?‌ থানার কনস্টেবল তো এদের থেকে ভাল তদন্ত করতে পারবে। সহজ কথা, যার ঘরে হাজার হাজার কোটি ঢুকেছে, আগে তাঁর অপরাধ প্রমাণ করে তাঁকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হোক। সেটা যতক্ষণ না হচ্ছে, দু একটা চুনোপুঁটি ধরে বাহাদুরি দেখানোর চেষ্টা সিবিআই যেন না করে। যাঁরা বাঁকা পথে চাকরি পেয়েছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে অপরাধী। কিন্তু তাঁদের সবার অপরাধ যোগ করলেও সেই ধেড়ে ইঁদুরের সমান হবে না। তাহলে সেই ধেড়ে ইঁদুর এখনও ভাষণ দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন কোথা থেকে?‌

সিবিআই বা ইডির জেরা থেকে বেরিয়েই তিনি একঘণ্টা ভাষণ দেওয়ার সাহস পান কোত্থেকে?‌ সিবিআই আমার কাঁচকলা করবে, এটা বলার স্পর্ধা পান কোত্থেকে?‌ তিনি এই সাহস পান, কারণ সিবিআই নিজেকে এই জায়গায় নামিয়ে এনেছে। এইসব চাকরিতে অনিয়ম ছিল, এটা প্রমাণ করতে সিবিআই নিশ্চিতভাবেই আদালতে কিছু প্রমাণ দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও সিবিআইকে পাসমার্ক দেওয়া যাচ্ছে না। তারপরেও
বলতে হবে, সিবিআই চূড়ান্ত ব্যর্থ।

তাই উল্লাস নয়। এত এত মানুষের চাকরি যাওয়া আসলে সিবিআইয়ের ব্যর্থতাই। বিচারব্যবস্থাও যেদিন সেই আসল অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারবে, সেদিন বলা যাবে উচ্চ ন্যায়ালয়। নইলে এক কলমের খোঁচায় এত চাকরি বানচালের পরেও এই রায়কে বৈপ্লবিক রায় বলা যাবে না। এতদিন আদালত বলেছে, আসল মাথাকে খুঁজে বের করুন। এবার আদালতের উদ্দেশেও সেই কথাটা বলার সময় এসে গেছে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.