কাকে মানাবে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকায়? মুম্বইয়ে তখন অভিনেত্রীর অভাব নেই। একের পর এক গ্ল্যামারাস মুখ। তবু গুলজারকে কিনা ছুটে আসতে হয়েছিল কলকাতায়! লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।
নিশ্চয় সেই আঁধি ছবির কথা মনে পড়ছে? সুচিত্রার হিন্দি ছবি বললে সবার আগে ওই ছবিটাই যে ভেসে ওঠে। অথচ, সুচিত্রা মাত্র একটি হিন্দি ছবি করেছেন, মোটেই এমন নয়। সাত সাতটি ছবির মধ্যে আঁধি ছবিটাই তাঁর শেষ ছবি। ওই শেষ ছবিটাই অবশ্য সবথেকে বেশি দাগ কেটেছিল দর্শকদের মনে।
আঁধিতে আসার আগে অন্য ছবিগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। সুচিত্রার প্রথম হিন্দি ছবি কিন্তু ১৯৫৫ সালে। শরৎচন্দ্রের দেবদাসকে সেলুলয়েডে এনেছিলেন পরিচালক বিমল রায়। দেবদাসের ভূমিকায় দিলীপ কুমার। আর সুচিত্রা হয়েছিলেন চন্দ্রমুখী। ১৯৫৭ তে মুক্তি পেল দুটো হিন্দি ছবি। হৃষীকেশ মুখার্জির মুসাফির এবং নন্দলাল কাওয়ান্তলালের চম্পাকলি। ১৯৬০ সালে দু’খানা ছবি করলেন দেবানন্দের সঙ্গে। ছবির নাম বোম্বাই কা বাবু, শরহদ। মাঝে কিছুদিনের বিরতি। বাংলায় ‘উত্তর ফাল্গুনী’ তখন সুপারহিট। তার আদলে ১৯৬৬ নাগাদ অসিত সেন হিন্দিতে বানালেন ‘মমতা’। মা ও মেয়ে দুই ভূমিকাতেই সুচিত্রা সেন। একজনের প্রেমিক অশোক কুমার, মেয়ের প্রেমিক ধর্মেন্দ্র। তারপর আরও আট বছরের ব্যবধান। ১৯৭৪ নাগাদ মুক্তি পেল আঁধি। মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হল নানা বিতর্ক। এমনকি জরুরি অবস্থায় নিষিদ্ধও করা হয়েছিল এই ছবিকে।
প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর একটি পর্ব থাকে। সেই পর্বটা তেমন মধুর নয়। কারণ, গুলজারের চিত্রনাট্য শুনে প্রথমে ফিরিয়েই দিয়েছিলেন সুচিত্রা। গুলজার তখন নবীন পরিচালক। খেটেখুটে, দরদ দিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন। একদিন একটা চিত্রনাট্য নিয়ে গেলেন সুচিত্রার কাছে। সুচিত্রা শোনার পর প্রাথমিকভাবে রাজি হলেন। কিন্তু বললেন, স্ক্রিপ্টের বেশ কিছু জায়গা বদল করতে হবে। গুলজার জানতে চাইলেন, কেন? সুচিত্রা বললেন, এখানে এমন কিছু সংলাপ আছে, যা আমাকে মানায় না। গুলজার মেনে নিলে হয়ত সমস্যা থাকত না। কিন্তু বয়স কম, তার ওপর কিছুটা ঠোঁটকাটা। গুলজারও বলে ফেললেন, ‘আপনার মুখে মানাবে কিনা, সেই ভেবে তো চিত্রনাট্য লেখা হয়নি। যে চরিত্রটার মুখে এই সংলাপ, তার মুখে কিন্তু এই সংলাপ বেমানান নয়।’ গুলজারের কথাগুলো বোধ হয় ঠিক পছন্দ হয়নি সুচিত্রার। তাই ছবি নিয়ে কথাবার্তা আর এগোলো না।
ওদিকে গুলজার মেতে রইলেন অন্যান্য ছবি নিয়ে। আস্তে আস্তে বেশ নাম ছড়াল। এদিকে সুচিত্রাও কলকাতায় একের পর এক ছবি করে চলেছেন। এদিকে সঞ্জীব কুমারের খুব ইচ্ছে, তিনি সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অন্তত একটা হিন্দি ছবি করবেন। প্রযোজক জে ওমপ্রকাশও চাইছেন সঞ্জীব–সুচিত্রা জুটিকে নিয়ে হিন্দি ছবি বানাতে। তাঁরা দুজনেই এলেন গুলজারের কাছে। তাঁদের ইচ্ছে, ছবিটা পরিচালনা করুন গুলজার। একটি গল্প শোনানো হল। কিন্তু গুলজারের ঠিক পছন্দ হল না। তিনি বললেন, ‘এ তো সাধারণ ছবি। এটার জন্য কলকাতা থেকে সুচিত্রা সেনকে আনতে হবে কেন? এটা তো বম্বের যে কোনও অভিনেত্রীই পারবে। সুচিত্রাকে যদি আনতেই হয়, তাহলে আরও ভাল কোনও ছবির জন্য আনতে হবে।’
নতুন করে বিষয় ভাবতে লাগলেন গুলজার। তখনই মাথায় এল আঁধির কথা। বলা হল সঞ্জীব কুমারকে। তিনি তো এককথায় রাজি। মনে হল, এই ছবির জন্য সুচিত্রাকে বলাই যায়। ততদিনে গুলজারও অনেকটা পোড়খাওয়া। বুঝেছেন, সুচিত্রা সেনকে রাজি করাতে হলে দরকার হলে চিত্রনাট্য একটু আধটু বদলানোই যায়। এবার গুলজার এলেন কলকাতায়। আগের সেই সাক্ষাতের কথা বেশ মনে আছে সুচিত্রার। তখন গুলজারও বলিউডের নামকরা পরিচালক। ফলে, সুচিত্রার মনেও কিছুটা সমীহ তৈরি হয়েছে। তাই এবার সুচিত্রা বললেন, গল্পটা যদি ভাল লাগে, নিশ্চয় করব। না ভাল লাগলে করব না। তবে আপনাকে চেঞ্জ করতে বলব না।
সুচিত্রা রাজি। বম্বে এসেই গুলজারকে বলতে শুরু করলেন স্যার। এত সিনিয়র অভিনেত্রী স্যার বলে ডাকছেন! কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিল গুলজারের। তিনি একবার সুচিত্রাকে বারণও করলেন। সুচিত্রার জবাব— ‘আপনি ডাইরেক্টর। আমি আপনাকে স্যারই বলব।’ গুলজার বললেন, বেশ, আমিও তাহলে আপনাকে স্যার বলব। সুচিত্রা বললেন, ঠিক আছে, তাই বলবেন। সেই থেকে দুজনেই একে অপরকে স্যার বলে সম্বোধন করতে শুরু করলেন।
কাজ শুরুও হয়ে গেল। নিছক একটা ছবি নয়। এই ছবি করতে গিয়ে কলকাতার বেশি কিছু ছবি ফিরিয়েও দিলেন। সুচিত্রাও চাইলেন মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করতে। যত ভোরেই শুটিং থাকুক, সুচিত্রা ঠিক সময়ে হাজির। বরং সমস্যা দেখা দিল নায়ক সঞ্জীব কুমারকে নিয়ে। তিনি একটু দেরিতে ঘুমিয়ে ওঠেন। তৈরি হয়ে আসতে অনেকটা সময় লেগে যায়। ভয়ে ভয়ে রইলেন গুলজার। সুচিত্রার মেজাজের কথা ততদিনে তিনিও জেনে গেছেন। ভয় হচ্ছে, যদি সুচিত্রা বলে বসেন, আমি কারও জন্য অপেক্ষা করতে পারব না, আপনি অন্য কাউকে দিয়ে ছবি বানান। আমি চললাম।
না, তেমনটা ঘটেনি। বরং সুচিত্রা সমস্যাটা বুঝতে পেরে নিজেই দায়িত্ব নিলেন সঞ্জীবকে ঘুম থেকে তোলার। ততদিনে তিনি মজা করে সঞ্জীব কুমারের একটি নামকরণ করে ফেলেছেন। অন্য নায়কদের তুলনায় সঞ্জীব একটু মোটা ছিলেন। তাই সুচিত্রা ডাকতে শুরু করলেন ‘মোটু’। শুরুর দিকে আড়ালে আবডালে। পরের দিকে সবার সামনেই ডাকতে লাগলেন ‘মোটু’ বলে। অন্য কেউ এই নামে ডাকলে সঞ্জীব কুমার নিশ্চয় রেগে যেতেন। কিন্তু সুচিত্রা ডাকলে হজম না করে উপায় কী!
সকাল হলেই সঞ্জীবের ঘরে সুচিত্রার ফোন চলে যেত। এই যে মোটু, এবার ওঠো। তাড়া দিয়ে নিয়ে আসতেন লোকেশানে। শুটিংয়ে এসে স্পটবয়দের বলতেন, মোটুকে লিয়ে চায়ে লে আও। বেচারা সঞ্জীব! তখন মুচকি মুচকি হাসতেন। কারণ, ততদিনে তিনিও সুচিত্রার ফ্যান হয়ে পড়েছেন। ছবিতে নানা বয়সের নানা মুহূর্ত ফুটে উঠেছে। কখনও তিনি প্রেমিকা, কখনও জনতার ভিড়ে জনপ্রিয় নেত্রী। কখনও রাগী, কখনও স্নেহশীলা। সব দৃশ্যেই সাবলীল। আর ওই গান! তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই, তুম আগেয়ে হো, ইস মোড় সে জাতি হো। গানগুলো ঝড় তুলল মানুষের হৃদয়ে।
সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীর জীবনীকে ভিত্তি করে তৈরি নয়। তবে কোথাও কোথাও ছায়া তো আছেই। ইন্দিরা গান্ধী নিজেও ভেবে নিলেন এই ছবি তাঁকে নিয়ে তৈরি। ফলে, জরুরি অবস্থার সময় গুলজারের তৈরি ছবিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর জনতা সরকার আবার সেই ছবিকে ছাড়পত্র দিল। শুধু তাই নয়, দূরদর্শনেও দেখানো হল।
এদিকে নিজেকে ততদিনে গুটিয়ে নিয়েছেন সুচিত্রা। ছবির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এমনকি পুরনো মানুষদের সঙ্গেও আর সম্পর্ক নেই। কিন্তু গুলজারের সঙ্গে পুরনো বন্ধুত্ব থেকে গেল। গুলজার কলকাতা এলেই সুচিত্রার ঘরে ঠিক ডাক পড়ত। একবার গুলজার কলকাতায় এসেছেন। কিন্তু সুচিত্রার সঙ্গে দেখা করেননি। রাতে গ্র্যান্ড হোটেলে তাঁর ঘরে একজন টোকা দিলেন। সুচিত্রার ঘনিষ্ঠ একজন বললেন, চলুন, উনি লবিতে বসে আছেন। সে কী, স্বয়ং সুচিত্রা হোটেলের লবিতে! দ্রুত নেমে এলেন গুলজার। দেখলেন, লবির একেবারে কোনের দিকে একা বসে আছেন এক মহিলা। হ্যাঁ, তিনিই সুচিত্রা সেন। গুলজার বললেন, এ কী! আপনি নিজে? আপনি তো বাইরে বেরোন না। লোকে দেখে ফেলবে তো! সুচিত্রা বললেন, দেখুক, আপনি আমার গাড়িতে উঠুন। জোর করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। খাইয়ে দাইয়ে তারপর ফেরত পাঠালেন।
সুচিত্রার বাড়িতে গুলজারের যাতায়াত আছে, এটা অনেকেই জানতেন। দুইয়ে দুইয়ে চার হতে কতক্ষণ! খবর ছড়িয়ে গেল, আবার ছবিতে ফিরছেন সুচিত্রা। কাগজে রীতিমতো সুপারলিড হল। সুচিত্রা তখন পন্ডিচেরিতে। কিন্তু সেখানেও এই খবর পৌঁছে গেল। না, তিনি কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। তারপর কী হয়েছিল? গুলজারের মুখেই শোনা যাক। ‘কলকাতায় ফেরার পরই আমি তাঁকে ফোন করলাম। একথা সেকথার পর বললাম, শুনেছেন খবরটা?’ উনি হাসলেন। জানতে চাইলাম, সত্যিই ছবি করবেন না আর? উনি কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি বললেই করব।’
তাহলে আর বললেন না কেন? গুলজার বললেন, ‘আমি জানি, উনি আর ছবি করবেন না। হাসতে হাসতে বললেন ঠিকই, কিন্তু সুচিত্রা সেনের মনের কথা আমি জানতাম। তাই জোরাজুরি করিনি। আমি জোরাজুরি করলে তাঁকে ‘না’ বলতে হত। সেটা আমি চাইনি। চাইনি একটা সুন্দর বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাক।’
না, জোরাজুরি করেননি গুলজার। জানতেন, সুচিত্রা সেনের বন্ধু হতে গেলে অন্তত কিছু সংযম দরকার। তাই বন্ধুত্ব শেষদিন পর্যন্ত অটুট ছিল। অনেকের জন্য দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও গুলজারের জন্য ওই বাড়ির দরজা চিরদিন খোলাই ছিল।