সাংসদের কাজ কী, এই অর্বাচীনরা আদৌ বোঝেন!‌

রক্তিম মিত্র

কোন এমপি কতটা সফল?‌ কে এলাকায় কেমন কাজ করেছেন?‌ ভোটের বাজনা বাজলেই টিভিতে, কাগজে এই নিয়ে নানা আলোচনা, নানা পরিসংখ্যান। এমপি–‌রাও নিজের নিজের কাজের ফিরিস্তি দিয়ে চলেন। এসব দেখে একটা কথাই বোঝা যায়, এমপি–‌র কাজ কী, তা অধিকাংশ এমপি–‌ই বোঝেন না। আর যাঁরা এইসব সমীক্ষা করছেন, তাঁরাও বোঝেন না। এমপিকে পঞ্চায়েত প্রধানের স্তরে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এবং, তৃণমূলের অধিকাংশ এমপি যেহেতু এমপি–‌র কাজটাই বোঝেন না, তাই নিজেরাও নিজেদের পঞ্চায়েত প্রধানের পর্যায়ে নামিয়ে আনছেন।

সংসদে কদিন হাজিরা, কটি প্রশ্ন তুলেছেন, কটি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। এরকম একটা পরিসংখ্যান অনেকে কাগজে বা চ্যানেলেই উঠে আসছে। এগুলো একজন এমপি–‌র কাজের সামান্য অংশ। এই রাজ্যের অধিকাংশ এমপি সেজেগুজে লোকসভায় বসে থেকেছেন। কী আলোচনা হচ্ছে, সেসব বোঝেনওনি। কারণ, বোঝার জন্য যে পড়াশোনা বা চর্চা লাগে, তার পাঁচ শতাংশও নেই। তাঁদের একটাই কাজ, নেত্রীর নির্দেশ এলেই হল্লা করে যাওয়া। আর ওয়াকআউট করে গান্ধী মূর্তির সামনে চলে আসা। তারপর কারও মাথায় কলসী, কোনও দিন গায়ে কালো সাল, কোনওদিন হাতে পোস্টার। আসলে, পার্লামেন্টটাকে দিনের পর দিন মূর্খের আখড়া বানানোয় আমাদের এমপিদের ভূমিকাও কম নয়।

আলোচনা শুনে মনে হচ্ছে, একজন এমপি–‌র কাজকর্ম বুঝি শুধু এমপি তহবিলের টাকা খরচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটা এমপি–‌দের অজ্ঞতা। সেইসঙ্গে কলকাতার কুয়োয় বসে যাঁরা বাংলার সমুদ্র বোঝার চেষ্টা করেন, তাঁদেরও অজ্ঞতা। আসলে, একটা লোকসভা কত বড় হয়, সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। কোন লোকসভার মধ্যে কোন কোন বিধানসভা পড়ে, সেসম্পর্কেও কোনও ধারণা নেই। তাই এই সীমাহীন অজ্ঞতা গেলানো হচ্ছে দর্শক ও পাঠককে।

একজন এম পি এলাকা উন্নয়নে বছরে কত টাকা পান?‌ পাঁচ কোটি। এম পি–‌রা পরিসংখ্যান দিয়ে চলেছেন, চারটি পথবাতি, দুটি শ্মশান সংস্কার, ছটি অ্যাম্বুলেন্স, তিনটি চিলড্রেন্স পার্ক, তিনটি গ্রামীণ রাস্তা, তিনটি নিকাশি নালা, ছটি সীমানা প্রাচীর ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে ভাই, এটা কোনও এম পি–‌র কাজ?‌ একজন পঞ্চায়েত প্রধান তো এক বছরে এর থেকে বেশি কাজের ফিরিস্তি দিতে পারেন।
একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের বাজেট কত, ধারনা আছে?‌ কতগুলি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে একটি লোকসভা হয়, ধারনা আছে?‌ একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে বছরে গড়পড়তা প্রায় পাঁচ কোটি টাকার কাজ হয়। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কাজের রূপায়ণ ধরলে অঙ্কটা সাত থেকে আট কোটি। অর্থাৎ, একজন প্রধান চাইলে বছরে আট কোটি টাকার কাজের ফিরিস্তি দিতে পারেন।

 

পনেরো থেকে কুড়িটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে একটি বিধানসভা। এমন সাতটি বিধানসভা নিয়ে একটি লোকসভা। অর্থাৎ, একটি লোকসভার মধ্যে প্রায় ১২০ খানা গ্রাম পঞ্চায়েত (‌শহুরে বুদ্ধিজীবীরা আবার একটি গ্রাম পঞ্চায়েত মানে একটি গ্রাম ভেবে নিতে পারেন। তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, একটি গ্রাম পঞ্চায়েত মানে কোথাও কোথাও পনেরোটিও বেশি গ্রাম। একেকটি গ্রাম পঞ্চায়েতের ভেতর কলকাতার তিনটি বিধানসভা ঢুকে যাবে।)‌। অর্থাৎ, একজন এমপি–‌র লোকসভা এলাকায় প্রায় ১২০ জন পঞ্চায়েত প্রধান থাকেন। দেখা যাচ্ছে, একজন এম পি কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছেন, একজন প্রধানের ফিরিস্তি তার থেকে অনেক বেশি। তার মানে, একজন এম পি নিজেকে কোন স্তরে নামিয়ে আনছেন?‌

আসলে, এলাকা তহবিলের ফিরিস্তি কেবল অক্ষম এমপিরাই দিতে পারেন। আড়াই ‌দশক আগেও তো এলাকা উন্নয়ন তহবিলই ছিল না। তার মানে, তখন কি এম পি–‌র কোনও কাজ ছিল না?‌ তৃণমূলের অধিকাংশ এম পি বছরে ওই পাঁচ কোটি খরচটাকেই একজন এমপি–‌র কাজ বলে ভেবে নিয়েছেন। আর তাই ওই টাকা খরচ করে নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন। ১)‌ এলাকার কতগুলো সিঙ্গল লাইনকে ডাবল লাইন করার উদ্যোগ নিয়েছেন?‌ ২)‌ কটা নতুন ট্রেন চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন?‌ ৩)‌ বৈদ্যুতিক লাইন করার পেছনে কতটুকু ভূমিকা আছে?‌ ৪)‌ রেলের কারখানা বা হাসপাতাল করার ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ আছে?‌ ৫)‌ মেট্রো রেলের কাজ বছরের পর বছর ধরে ঢিমেতালে চলছে কেন?‌ দশ বছরেও নতুন কোনও লাইন তৈরি হল না কেন?‌ ৬)‌ রাজ্যের অসমাপ্ত রেলপ্রকল্পগুলি কী অবস্থায় আছে?‌ ৭)‌ বিভিন্ন এলাকায় ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস করার ক্ষেত্রে কতটুকু উদ্যোগ নিয়েছেন?‌ শুধু রেল নিয়েই আরও একগুচ্ছ প্রশ্ন তোলা যায়। এর বাইরে আরও অন্তত পঞ্চাশখানা দপ্তর আছে। সেইসব দপ্তরের কী কাজ, সেইসব প্রকল্প কীভাবে নিজের রাজ্যে বা এলাকায় আনা যায়, সে ব্যাপারে কোনও ভাবনাচিন্তা বা শিক্ষাদীক্ষা আছে?‌ একজন এমপি চাইলে, উদ্যমী হলে নিজের এলাকায় বছরে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প আনতে পারেন। যাঁরা সেটা পারেন না, সেই অর্বাচীনরা পাঁচ কোটি টাকার ফিরিস্তি দেন।

একসময় এই রাজ্য থেকে কারা লোকসভায় গেছেন!‌ ত্রিদিব চৌধুরি, হীরেন মুখার্জি, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, চিত্ত বসু, প্রণব মুখার্জি, সোমনাথ লাহিড়ী, সোমনাথ চ্যাটার্জি, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, জ্যোতির্ময় বসু। এমনকী আট–‌নয়ের দশকেও বাসুদেব আচারিয়া, সৈফুদ্দিন চৌধুরি, প্রমথেশ মুখার্জি, গুরুদাস দাশগুপ্ত। কী সব দুরন্ত ডিবেট!‌ সৌগত রায়, আর কিছুটা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আর এই টার্মে মহুয়া মৈত্র ছাড়া তৃণমূলের কারও সেই রাজনৈতিক উচ্চতা আছে?‌ সব তালে তালে দিয়ে যাওয়া হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙ। সংসদের মানকে কোথায় টেনে নামাচ্ছেন তৃণমূল সুপ্রিমো!‌ এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। মিমি কী পোশাক পরলেন, নুসরত কী খেলেন, আগেরবার সেই আলোচনা লোকে রসিয়ে রসিয়ে গিলেছে। এবারের মাতামাতি রচনা ব্যানার্জি, জুন মালিয়া বা সায়নী ঘোষদের ঘিরে। ভাগ্যিস, মিমি–‌নুসরতরা নেই। নইলে, আরও কত ন্যাকামি যে দেখতে হত, কে জানে!‌ বছরে পাঁচ কোটির বাইরেও যে একটা বিরাট জগৎ আছে, সেটা এই অর্বাচীনদের কে বোঝাবে!‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.